Monday, August 26

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার টাপুরে নৌকা

আমতলী (বরগুনা): ৫০ বছর ধইরা নাও বাই। তয় এহন আগের মতোন মানুষ নায়(নৌকা) ওডেনা। মানুষ এহন কম সমযে যাওয়ার লইগা ট্রলারে ওডে। নাওয়ের এহন আর কদর নাই। সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া আমাদের গ্রাম বাংলার নদী, খাল, বিলের টাপুরে নৌকার বেহাল দশা বলতে গিয়ে বরগুনার আমতলী  উপজেলার পচাকোড়ালিয়া  গ্রামের পায়রা  নদীর ষাটোর্ধ বয়সি মাঝি জসিম মিয়া  এভাবে আক্ষেপের কথা বললেন। জসিম  মিয়া আজন্মকাল পায়রা  নদীতে নৌকায় যাত্রী পারাপার করেছেন। সে এই নদীর নৌকার পুরানো মাঝি। যান্ত্রিক নৌকার দাপটে বৈঠার টাপুরে নাও এখন ক্রমন্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেক মাঝি রোজগার কমে যাওয়ায় অন্য পেশায় জড়িয়ে গেছেন। 
আধুনিক সভ্যতার দাপটে গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী টাপুরে নাও। শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে বাংলার জনপদে নদী ও খালে চলাচলের জন্য নৌকার সৃষ্টি। এক সময় গ্রামের মায়েরা সন্তানকে ঘুম পড়ানো কিংবা দু’মুঠো খাওয়ানোর ছলনায় অতীতে হারিয়ে যাওয়া বাহনের কথা গল্পে রুপান্তরিত করে শোনান। এ সব বাহন এখন শুধু সময়ের স্মৃতি আর ইতিহাস। উনিশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও বিত্তবান ও মধ্যবিত্ত মানুষের কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে ঘোড়ার গাড়ী ও পালকীর প্রচলন আর অন্যদিকে পল্লী অঞ্চলের নিম্ন আয়ের মানুষের টাপুরে নাও (ছোট নৌকা ) ছিল একমাত্র বাহন। এ টাপুরে নৌকায় চড়ে বরযাত্রী যেতো  বিয়ে বাড়িতে।  আবার নতুন বৌ নিয়ে বরযাত্রী ওই টাপুরে নৌকায় ফিরে আসতো।  
বর্তমান আধুনিক সভ্যতার প্রচলন যান্ত্রিক বাহন  প্রাইভেট কার, মাইক্রো ও ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের  প্রভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে টাপুরে নৌকা। তার পরেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও টাপুরে নৌকা কোনমতে টিকে আছে। তবে পূর্বের ঐতিহ্য আর তেমন নেই। জমিদার আমলেই পানসী ও ছইওয়ালা নৌকার প্রচলন ছিল সর্বত্র। সে যুগে জমিদাররা পাল তোলা পানসী নৌকায় ভ্রমনের উদ্দ্যেশে নৌ-বিলাসে বের হতেন। 
প্রাচীন কালের ঐতিহ্য কয়েক যুগ টিকে থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন যান্ত্রিক বাহন ও ইঞ্জীনচালিত স্যালোবোটের প্রভাবে ঐতিহ্যবাহী কেরাও নাও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। গ্রামীণ জনপথের বাহন হিসেবে প্রচীন কাল থেকেই চলে আসছে পালকী, ঘোড়ার গাড়ী বা বিভিন্ন ধরনের নৌকার ব্যবহার যা এখন দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া  পালতোলা নৌকা, কাঁঠামী নৌকা আর বাওয়ালী নৌকা এখন কালের বিবর্ততনে বিলুপ্তির পথে। 
সম্রাট আকবরের আমলে পালতোলা পাঁনসি নৌকায় জমিদাররা বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে বানিজ্য করতে আসতেন। সেই পাঁনসি নৌকা এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে প্রায় দুইশত বছর পূর্বে। গ্রাম গঞ্জের নৌপথে চলাচলে ইঞ্জীন চালিত নৌকা দখল করে নিলেও কোন কোন ক্ষেত্রে এর চাহিদা এখনও অফুরন্ত। 
পল্লী অঞ্চলে যে সব স্থানে সারিবদ্ধ ভাবে নৌকার মাঝিরা যাত্রীর অপেক্ষায় থাকতেন সে সব স্থানে এখন শুধু ইঞ্জীন চালিত নৌকার চালকরা। প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে সব পেশাজীবী মানুষের শৌখীন ভাবে নৌ-পথে ভ্রমনের বাহন ছিল এটি। প্রাচীন কালে রাজা জমিদাররা যখন বজড়ায় চড়ে নৌ-বিলাসে বের হতেন তখন থেকেই মধ্যবিত্ত নিম্ম মধ্যবিত্তের বাহন হিসেবে কেরাও নাওয়ের প্রচলন শুরু হয়। এভাবেই গড়ে উঠে টাপুরে নৌকার সংস্কৃতি। সময়ের বিবর্তনে আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে এ সবই এখন শুধু সময়ের স্মৃতি আর ইতিহাস হতে চলেছে। 
উপকূলিয় বরগুনা জেলায়  গত বিশ বছর পূর্বেও অন্তত লক্ষাধিক টাপুরে নৌকা ছিল। এ টাপুরে নৌকা চালিয়ে  সংসার চলতো এসব মাঝি পরিবারের । এ পেশায় পূর্বের মতো আর রোজগার না থাকায় ছেলে মেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে টাপুরে নৌকার মাঝিরা। অন্য দিকে এ পেশা ছেড়ে দিয়ে অনেকে অন্য পেশায় জড়িয়ে গেছে । ----ডিনিউজ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়