Saturday, December 27

কেমুসাসের ‘শেকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা–২০২৫’ প্রসঙ্গে কিছু কথা


মিলন কান্তি দাস:

কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সংক্ষেপে কেমুসাস। সিলেটের একটি ঐতিহ্যবাহী ও মর্যাদাসম্পন্ন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান। সিলেটের সাহিত্য তীর্থ হিসেবে সুপরিচিত এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চায় নিয়োজিত। কেমুসাসে বছরজুড়েই সাহিত্যকেন্দ্রিক নানা আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক সাহিত্য আসর, লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন, কবি সম্মেলন, কেমুসাস বইমেলা, সাহিত্য পুরস্কার প্রদান, বিভিন্ন গুণী লেখকের জন্ম ও মৃত্যুদিন পালন এবং তাঁদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি।

এই ধারাবাহিক কার্যক্রমেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো “কেমুসাস শেকড়ের সন্ধানে অভিযাত্রা”। এ অভিযাত্রার মূল উদ্দেশ্য-যেসব কবি, সাহিত্যিক ও গীতিকার তাঁদের সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করেছেন, সাধারণ মানুষকে সাহিত্য ও সংস্কৃতির পথে অনুপ্রাণিত করেছেন,তাঁদের শেকড়কে অনুসন্ধান করে জাতির সামনে তুলে ধরা।

অষ্টম অভিযাত্রা : কানাইঘাটে মরমী কবি ইব্রাহিম তশ্না (রহঃ)

এমনই এক অভিযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ইং, বৃহস্পতিবার। এটি ছিল কেমুসাসের অষ্টম অভিযাত্রা। এবারের গন্তব্য-কানাইঘাট উপজেলার ৬নং সদর ইউনিয়নের বাটইশাইল গ্রামে অবস্থিত মরমী কবি ইব্রাহিম তশ্না (রহঃ)-এর বাড়ি

মরমী কবি ইব্রাহিম তশ্না (রহঃ) ছিলেন ব্রিটিশ শাসনামলের একজন মনীষী, জ্ঞানতাপস ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারতের বিখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন আলেম ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আসাম অঞ্চলের কার্যকরী সদস্য।

জীবদ্দশায় তিনি ইসলাম প্রচারে নিবেদিত ছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মাদ্রাসা ও মসজিদ। তবে তাঁর সবচেয়ে স্বতন্ত্র পরিচয় ছিল তাঁর সংগীত সাধনা। তিনি মরমী ও ইসলামী ভাবধারায় অসংখ্য গানের গীতিকার ও সুরকার ছিলেন। যা তাঁর অনন্য অবদান হিসেবে আজও স্মরণীয়।


দিনব্যাপী আয়োজন ও অভ্যর্থনা

এই ঐতিহাসিক অভিযাত্রা উপলক্ষে মরমী কবি তশ্না (রহঃ)-এর বাড়িতে ছিল দিনব্যাপী কর্মসূচি। অভিযাত্রা কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কবি ও বাচিক শিল্পী সালেহ আহমদ খসরু এবং সদস্য সচিব ছিলেন বিশিষ্ট ছড়াকার কামরুল আলম

সকাল ৯টায় সিলেটের কেমুসাস প্রাঙ্গণ থেকে অভিযাত্রা শুরু হয়। দুপুর ১২টার দিকে কেমুসাস অভিযাত্রী দল উমরগঞ্জ মাদ্রাসা মাঠে পৌঁছালে স্থানীয় আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে তাঁদের উষ্ণ সংবর্ধনা জানানো হয়।
স্থানীয় আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন কবি সরওয়ার ফারুকী এবং সদস্য সচিব জাহেদ হোসাইন রাহিন। আরও উপস্থিত ছিলেন মিলন কান্তি দাস, শাহজাহান শাহেদ, মহিউদ্দিন জাবের ও আব্দুল কাদির ফারুক। সংবর্ধনায় অংশ নেন উমরগঞ্জ মাদ্রাসার সম্মানিত মুহতামিম, ছাত্রবৃন্দ ও স্থানীয় এলাকাবাসী।

অভিযাত্রী দল

অভিযাত্রা দলে উপস্থিত ছিলেন বাংলা সাহিত্যের গুণী কবি কালাম আজাদ, বিশিষ্ট কলামিস্ট আফতাব চৌধুরী, কেমুসাসের সাবেক সভাপতি হারুনুজ্জামান চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক গল্পকার সেলিম আউয়াল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান মাহমুদ রাজা চৌধুরী, কবি সালেহ আহমদ, কবি কামাল তৈয়ব, ভ্রমণ লেখক ও সাংবাদিক মোয়াজ আফসার, কবি অধ্যক্ষ নাজমুল আনসারী, ড. তুতিউর রহমান, ছড়াকার সাজ্জাদ হোসাইন সাজু, কবি শান্তা কামালী, প্রকাশক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল, লুৎফুর রহমান তোফায়েল, শামসীর হারুনুর রশীদ, মাহজারুল ইসলাম জয়নাল প্রমুখ।

মূল অনুষ্ঠান

জোহরের নামাজ ও মাজার জিয়ারত শেষে মধ্যাহ্নভোজের পর শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কবি সালেহ আহমদ খসরু এবং সঞ্চালনা করেন ছড়াকার কামরুল আলম। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সূচিত হয়।

স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন কানাইঘাট সাহিত্য সংসদের সভাপতি, বিশিষ্ট কবি ও শেকড় সন্ধানী লেখক সরওয়ার ফারুকী। তিনি তাঁর বক্তব্যে মরমী কবি ইব্রাহিম তশ্না (রহঃ)-এর ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক জীবন, ধর্মীয় সাধনা ও সাহিত্যকর্ম গভীরতা ও আবেগের সঙ্গে তুলে ধরেন। তিনি তশ্না সাহেবের প্রপৌত্র হিসেবেও গর্বের সঙ্গে তাঁর উত্তরাধিকার রক্ষার দায়িত্ব কেমুসাসের প্রতি অর্পণ করেন।

কেমুসাস অভিযাত্রী দলের অন্যান্য বক্তারাও তশ্না (রহঃ)-এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা করেন এবং তাঁর রচনাসমগ্র নিয়ে গবেষণা ও গ্রন্থ প্রকাশের আগ্রহ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানে শিল্পী হায়দার-এর কণ্ঠে তশ্না সংগীত পরিবেশিত হলে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হন।

অনুষ্টানে স্থানীয়দের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কলামিস্ট মাস্টার মোঃ মহিউদ্দিন, বিশিষ্ট জন মাওলানা শামসুল হুদা,সমাজ সেবক মাস্টার ফয়সল আহমদ,কানাইঘাট প্রেসক্লাব সভাপতি নিজাম উদ্দিন,সাধারন সম্পাদক মাহবুবুর রশীদ,সাংবাদিক মুমিন রশীদ,আমিনুল ইসলাম,মাহফুজ সিদ্দিকী প্রমুখ।


আবৃত্তি ও সমাপ্তি

অনুষ্ঠানের শেষাংশে বাচিক শিল্পী সালেহ আহমদ খসরুর কণ্ঠে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতা “বলো বীর, চির উন্নত মম শির”—এর আবৃত্তি পরিবেশিত হয়, যা ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও স্মরণীয়।

মাগরিবের পূর্বেই অনুষ্ঠান শেষ হয় এবং কেমুসাস অভিযাত্রী দল সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন।

প্রত্যাশা ও উপলব্ধি

সব মিলিয়ে দিনটি ছিল কানাইঘাটের সাহিত্যাঙ্গণের জন্য এক ঐতিহাসিক ও প্রেরণাদায়ী দিন। কেমুসাস অভিযাত্রীদের আগমনে স্থানীয় সাহিত্যিকরা সম্মানিত ও উৎসাহিত হয়েছেন। একই সঙ্গে অভিযাত্রী কবিরাও কানাইঘাটের সাহিত্য সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি অর্জন করেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কানাইঘাট সাহিত্যচর্চায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। অতীত ও বর্তমান মিলিয়ে এখানকার বহু লেখকের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তবে প্রচারবিমুখতা ও অবমূল্যায়নের কারণে অনেক গুণী সাহিত্যিক কালের আড়ালে হারিয়ে গেছেন-এটাই বর্তমান সাহিত্যিকদের একটি বড় আশঙ্কা।

তাঁদের প্রত্যাশা,সিলেটের সাহিত্যাঙ্গণের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক কেমুসাস যেন কানাইঘাটের অতীত ও বর্তমান সাহিত্যিকদের যথাযথ মূল্যায়নের দায়িত্ব নেয়। কেমুসাস দায়িত্বশীলভাবে কাজ করলে সিলেট বিভাগের সাহিত্য ও সাহিত্যিকরা যুগের পর যুগ প্রজন্মের কাছে জীবিত থাকবে-এই বিশ্বাসই তাঁরা লালন করেন।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ইং দিনটি যেমন কেমুসাস অভিযাত্রীদের জন্য স্মরণীয়, তেমনি কানাইঘাটের সাহিত্যিকদের জন্যও ছিল এক ঐতিহাসিক ও অনুপ্রেরণার দিন। এই অভিযাত্রা যেন ক্ষণস্থায়ী না হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন পায়-এই দায়িত্ব কেমুসাস কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে পালন করবেন-এটাই সকলের প্রত্যাশা।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়