Saturday, September 2

কামিল হত্যা: অবশেষে মুখ খুললেন স্থানীয় জনতা, দ্রুত গ্রেফতার ও ফাঁসি দাবি


নিজস্ব প্রতিবেদক :

চাচাদের হাতে পরিকল্পিতভাবে সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ৭ নং দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউনিয়নের বাণীগ্রাম নিবাসী যুবক কামিল আহমদ নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর স্থানীয় জনগণের মাঝে নিরবতা বিরাজ করছিল। খুনীরা প্রভাবশালী হওয়ায় প্রথমে ভয়ে স্থানীয় জনতা মুখ খোলেনি। হত্যাকাণ্ডের ১৩ দিন পর আজ শনিবার কামিলের বাড়িতে অনুষ্ঠিত কুলখানি ও দোয়া মাহফিলে স্থানীয় জনতা উপস্থিত হয়ে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। তারা খুনিদের বিচার ও ফাঁসি দাবি করে। 

২১ আগস্ট তারিখে নিহত কামিলের রুহের মাগফেরাত কামনা করে কুলখানি ও দোয়া মাহফিল আজ শনিবার সকালে নিহত কামিলের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে অনেক স্থানীয় লোক বিশেষ করে প্রতিবেশি, গ্রাম, গোত্র ও আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন। 

কুলখানি ও দোয়া মাহফিলে স্থানীয় জনতার মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট মুরব্বী বানীগ্রাম নিবাসী হাজী আহমদ আলী,  বিশিষ্ট সালিশ ব্যক্তিত্ব ব্রাহ্মণগ্রাম নিবাসী নুর উদ্দিন, সালিশ ব্যক্তিত্ব তাজ উদ্দিন, কামাল উদ্দিন, কবির বিন ফয়জুর, এখলাছুর রহমান, মার্চেন্ট জয়নাল আবেদীন, মাষ্টার মাসুদ আলম, কবির বিন শফই, ইসলাম উদ্দিন, বিশিষ্ট মুরব্বী আব্দুর রহমান পাখি মিয়া, এনাম উদ্দিন চান মিয়া, গাছবাড়ী বাজার সিএনজি স্টেশনের সভাপতি আতাউর রহমান আতাই, মেহেদী হাসান নাসির, শাহিন আহমদ প্রমুখ। 

এ সময় উপস্থিত জনতা তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কামাল উদ্দিন বলেন, “কামিল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার। জমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হওয়ায় আলাই, নিজাম-সহ চাচারা এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে আমাদের গ্রাম গোষ্ঠীকে কলংকিত করেছে। খুনীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার, যাতে আমাদের এলাকায় আর কেউ কাউকে পরিকল্পিত হত্যার সাহস না করে।”

কামাল উদ্দিন আরো বলেন, “জমি-জমা নিয়ে চাচাদের সাথে কামিলের বিরোধটি আমরা কিছুদিন আগে সালিশে প্রাথমিকভাবে নিষ্পত্তি করে দেই। সেদিন আমরা কামিলকে বলেছি, তুমি আর চাচাদের সাথে বিরোধে যাবানা। আরো কয়েক দিন গেলে আমরা তোমার জমি-জমা বুঝিয়ে দেবো। সেই কয়েকদিন যাবার আগে কামিলকে খুন করা হলো, যা খুবই দুঃখজনক।”

তাজ উদ্দিন বলেন, কামিল ভালো ছেলে ছিল। জমি-জমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে তার চাচাগণ ছাড়া গ্রাম, গোষ্ঠী বা এলাকার কারো সাথে তার কোন বিরোধ ছিল না। কামিলের বাড়ির এই চাচারা অতীতেও তার উপর নৃশংসতা চালিয়েছে। এমনকি কয়েক বছর আগে তার ঘর-দরজা জ্বালিয়ে পুড়িয়েও দেয়। তার মা, বাবা, বড় ভাই বা বড় বোন কেউ না থাকায় সে তার চাচাদের কর্তৃক দখল হওয়া জমি-জমা উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন সময় কথা বলে। এতিম-অনাথ ভাই-বোনদের জবর দখল হওয়া জমি উদ্ধারের বিষয়টিই কামিলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। 

বানীগ্রাম নিবাসী বিশিষ্ট সালিশ ব্যক্তিত্ব এখলাছুর রহমান চিহ্নিত খুনীদের ফাঁসি দাবি করেন। তিনি বলেন, কামিলের প্রতিবেশি হওয়ায় এবং ঘটনাস্থল তার বাড়ির পাশে হওয়ায় হত্যাকাণ্ডের পর খুনীদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উল্লাস করে যেতে দেখেছেন। খুনীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ঘটনার পর ভয়ে সবাই চুপ ছিলেন। কিন্তু এতিম-অনাথ দুই বোনের অসহায়ত্ব ও কান্নাকাটি দেখে এখন স্থানীয় কিছু মানুষ বিবেকের তাড়নায় মুখ খুলছেন ও খুনীদের গ্রেফতার দাবি করছেন। এখলাছুর রহমান আরো বলেন, এই আসামীরা অতীতেও এই অসহায় কামিলের উপর অত্যাচার চালিয়েছেন। তার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব লুট করে নিয়েছে। এই খুনীরা ভয়ংকর। তাদের বিচার না হলে এলাকায় শান্তি ফিরে আসবে না। 

ব্রাহ্মণগ্রাম নিবাসী গোষ্ঠীর মুরব্বী ইসলাম উদ্দিন বলেন, জমি-জমা নিয়ে তার চাচাদের সাথে কামিলের বিরোধ ছিল। আমরা এই নিয়ে একাধিক বার সালিশ বৈঠকে বসেছি এবং এই নিয়ে যাতে চাচা-ভাতিজারা যাতে ভবিষ্যতে আর বিরোধে জড়িত না হন, সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত দিয়েছি এবং কামিলের জমি-জমা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। এমনকি চাচাদের সাথে কিছু কথা কাটাকাটির কারণে আমাদের গোষ্ঠীর প্রথা অনুযায়ী আমরা কামিলকে ৫ হাজার টাকা জরিমানাও করেছি। সে জরিমানা দিয়েছে এবং অঙ্গিকার করেছে সে আর বিরোধে জড়াবে না। কামিল অঙ্গিকারনামা দেওয়ার পর কেন তাকে চাচারা তাকে হত্যা করলো-- এই নিয়ে আমরা হতবাক হয়েছি। 

কারা কামিলকে খুন করেছে- এমন প্রশ্নের জবাবে ইসলাম উদ্দিন বলেন, কামিলের আপন চাচা আলাইর সাথে জমি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ ছিল। কামিল মারা যাওয়ার আগে সে তার বোনদেরকে বলেছে, আলাই, নিজাম, শরীফ, শাহিন, ছয়ফুল আলম, হারুন, তোতা- এরা খুন হামলা করেছে। মুরব্বী ইসলাম উদ্দিন খুনীদের অবিলম্বে গ্রেফতার কানাইঘাট থানার ওসি ও থানা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। 

বাণীগ্রাম নিবাসী প্রবাসী কবির বিন ফয়জুর বলেন, এই ঘটনায় তিনি হতবাক। খুনীরা প্রভাবশালী হওয়ায় ঘটনার পরও কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকি গুরুতর আহত কামিলকে হাসপাতালে নেওয়ারও কেউ ছিলনা। ছোট দুই বোন অন্য গ্রামের আত্মীয়দের সহায়তায় কামিলকে হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এমনকি কামিল নিহত হওয়ার পরও খুনীদের ভয়ে কোন একটি মানুষও কামিলের বাড়িতে আসেনি। কামিল নিহত হওয়ার খবর পেয়ে অনেক আত্মীয় তাদের ঘরে আসেন। ক্ষুধার্ত আত্মীয়দের পাশেও কেউ দাঁড়ায়নি। তখন আমি প্রথম এগিয়ে আসি এবং আত্মীয়দের জন্য খাবারের আয়োজন করি। কামিলের চাচারা কামিলকে খুন করেছেন। এই খুনীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের মাধ্যমে ফাঁসি দাবি করেন কবির বিন ফয়জুর। 

ব্রাহ্মণগ্রাম নিবাসী বিশিষ্ট মুরব্বী নুর উদ্দিন বলেন, কামিলের চাচা আলাই, তোতা, নিজাম, শরীফ, শাহিন, হারুন- এরা সবাই সব সময় ভয়ংকর লোক। এদের প্রভাবও আছে, টাকা পয়সাও আছে। এরা খুবই নিষ্টুর। আলাইর সাথে জমি নিয়ে কামিলের মূল বিরোধ। চাচারা কামিলকে হত্যা করে আমাদেরকে কলংকিত করেছে। আমরা এদের গ্রেফতার ও ফাঁসি চাই। 

কবির বিন শফই বলেন, কামিলের চাচা আলাই হচ্ছে খুনের মূল পরিকল্পনাকারী। এই ভয়াবহ খুনের পরিকল্পনায় শরীক হন নিজাম, শরীফ, তোতা, শাহিন, হারুন, ছয়ফুল প্রমুখ। রাতের অন্ধকারে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড মেনে নেওয়া যায় না। খুনীর চিহ্নিত। এই খুনীদের গ্রেফতার করতে হবে। 

এনাম উদ্দিন চান মিয়া বলেন, কামিলকে খুবই নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। খুনীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবী করে তিনি বলেন, এই হত্যা মামলার আসামীদের কেউ কেউ আরো বিভিন্ন অন্যায় কাজে জড়িত। বিশেষ করে ব্রাহ্মণগ্রামের গিয়াস উদ্দিন নামে এক প্রবাসীর কাছে ২২ লাখ টাকায় আসামী তোতা মিয়া জমি বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করে ফেলেন, কিন্তু জমি রেজিস্ট্রি দেননি।


আতাউর রহমান আতাই বলেন, কামিল ও তার ভাই-বোনরা যখন খুব ছোট ছিল, তখন আলাই বিদেশ থাকায় আলাই ছাড়া এই আসামীরা তথা কামিলের চাচারা কামিলের ঘর লুটপাট করেন, ঘরের সকল আসবাবপত্র ভাগাভাগি করে নেন। ছোট রেখে কামিলের মা-বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে এই পরিবারের উপর বাড়ির লোকজন বিশেষ করে এই খুনী চাচারা নিয়মিত নির্যাতন চালিয়ে আসছেন। 

কামিল খুনের কারণ সম্পর্কে আতাউর রহমান আতাই বলেন, কামিলের চাচারা বিশেষ করে আলাই কামিলদের জমি দখল করে রাখেন। এটাই হচ্ছে, কামিলকে খুন করার প্রধান কারণ। ১৩ দিন হয়ে যাবার পরও খুনীদের গ্রেফতার না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই খুনীরা জমি-খেকো, এরা মানুষের উপর বিভিন্ন সময় অত্যাচার-নির্যাতন করে, এদেরকে গ্রেফতার করে বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ফাঁসি দিতে হবে।

কুলখানি ও দোয়া মাহফিলে উপস্থিত সবাই কামিল হত্যার খুনিদের গ্রেফতার ও বিচার দাবি করেন। কামিলের রুহের মাগফেরাত কামনা করেন। দোয়া মাহফিলে শিরনীর আয়োজন করা হয়।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়