Saturday, April 9

কানাইঘাটের ৩ জয়িতার গল্প


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক :

বাধা পেরিয়ে এগিয়ে চলা : কানাইঘাটের ৩ জয়িতার গল্প এক সময় নারীদের বলা হতো অবলা। করা হতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। নারীদের কাজের কোনো মূল্যায়ন ছিল না ঘর কিংবা বাইরে। কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত যে নারীরা সীমাহীন পরিশ্রম করেন, তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতেই সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। মহিলা বিষয়ক অফিসের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমাজের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারীদের নির্বাচিত করে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার এমনই তিনজন নারীর সংগ্রামী জীবন ও সাফল্য তুলে ধরা হলো।


অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী:  

কানাইঘাট উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হানুফা বেগম। দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের কারণে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেননি। দরিদ্রতার কারণে তার পিতা মাতা তাকে পরিবাওে বোঝা মনে করতেন যার ফলে অল্প বয়েসে তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। যে পরিবারে তার বিয়ে হয় সেই পরিবারে আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। স্বামী ছিল একজন দিনমজুর। বিয়ের কিছুদিন পর তার কোলজুড়ে আসে সন্তান। তিন মেয়ে ও ১ ছেলে সন্তান এর জননী। পরিবারে অভাব অনটন দেখে নিজে কিছু করার চিন্তা ভাবনা করেন। সেই চিন্তা ভবানা থেকে তিনি স্ব-উদ্যোগে ধাত্রীর প্রশিক্ষণ নিয়ে এলাকায় দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন। ধাত্রীর কাজ করে তিনি তার ছেলেকে প্রবাসে পাঠিয়েছেন, বর্তমানে ছেলে প্রবাসে অবস্থান করছে ভালো অবস্থানে রয়েছে এবং ৩ মেয়েকে সুপাত্রের নিকট বিয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে মেয়েরা সুখে শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। তিনি কঠোর পরিশ্রম করে তার পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে সক্ষম হয়েছেন।  অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী হিসাবে তিনি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।


সফল জননী: 

সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম জাহানারা বেগমের। জাহানারা বেগম এর বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর ঠিক তখনই ছোট ছোট চার ভাই ও দুই বোন রেখে তার মা পরকালে পাড়ি জমান। বাকি ভাই বোনদেও দেখাশুনা ও পড়াশুনা করাতে গিয়ে তিনি মাত্র ৭ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি ভাই বোনকে মায়ের মমতা দিয়ে তাদেরকে আগলে রেখে পড়াশুনা করিয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি পাঁচ ছেলে ও দুইকন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী বীরমুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রকিব। তিনি তার স্বামীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেন এবং তার স্বামী স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন এবং দেশকে স্বাধীনতা এনে দিতে অবদান রাখেন। যার প্রভাব যুদ্ধকালীন সময়ে তার সংসারে এসে পড়ে এবং ঐ কয়েকটা মাস তাকে ও তার পরিবারকে অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে হয়। তার পাঁচ ছেলে এবং দুই মেয়েকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে অনেক প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে হয়।  স্বামীর সংসারে প্রায় আঠারো জন সদস্যের রান্না-বান্না অন্যান্য গৃহস্থলী কাজ শেষ করে নিজে বিশ্রাম না নিয়ে বাচ্চাদের লেখাপড়া করানোর জন্য নিয়ে বসতেন। তিনি মাত্র সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেও সন্তানদের পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নিজেই গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এসব কায়িক শ্রম কিছুই মনে হচ্ছিলনা যখন ১৯৯৬ সালে তিনি জানতে পারেন স্বামী দুরারোগ্য ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত,  তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। এরপর শুরু হয় আরেক সংগ্রাম। একদিকে ছোট ছোট সন্তানদের লেখাপড়া অন্যদিকে অসুস্থ স্বামীর সেবা এবং চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা। দুঃখ যেন পিছু ছাড়ছিলনা, ঠিক ঐ মুহুর্তে ১৯৯৮ সালে তার স্বামী পরকালে পাড়ি জমান। এরপর শুরু হয় তার জীবনে সবচেয়ে কঠিন দিনগুলো। অনেক সময় না খেয়ে না পরে বাচ্চাদেও লেখাপড়া করানোর জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়।  তার বড় ছেলে ১৯৯৮ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে খুব ভালো  ফলাফল অর্জন করে এবং তার এ ফলাফল দেখে তিনি মনঃস্থির করেন যেভাবে হোক বাকি সন্তানদের পড়ালেখা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু স্বপ্নটা বাস্তবায়ন করা মোটেও সহজ সাধ্য ছিলনা। প্রতিটি দিন তার নিকট বছর সমান মনে হচ্ছিল। কোন ভাবেই বুঝতে পারছিলে না কোথা থেকে কিভাবে শুরু করবেন। তখন তিনি বিভিন্ন এনজিও হতে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে হাঁস মুরগি পালন ও বাড়ির আঙ্গিনায় শাক সবজি চাষ কওে কোনরকম দিনযাপন শুরু করেন। সন্ধ্যার পর সারাদিনের কাজ ও রান্নাবান্না শেষ করে তিনি সবাইকে মাটিতে পাটি বিছিয়ে পড়াতে বসতেন।  তখন এলাকার লোকজন তার দুঃখ কষ্ট দেখে ও অভাব অনটন দেখে ছেলেদেরকে কাজে দেওয়ার জন্য বারবার পরামর্শ দিত।  কিন্তু তিনি তাদের কথা না শুনে তাদের লেখাপড়া চালিয়ে যান এবং এরই ধারা বাহিকতায় তার  ছেলে-মেয়েরা কানাইঘাট উপজেলার মধ্যে ভালো ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হয়।  তাদের মধ্য হতে দুই ছেলে কানাইঘাট মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি ও সম্মাননাপত্র পায় এবং তারা দুইজন ২০০৯ এবং ২০১০ সালের কানাইঘাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ হতে অংশ গ্রহণ করে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। সবকিছু যখন ঠিকঠাক চলছিল ঠিক তখনই ২০১০ সালের কানাইঘাট সুরমা নদীর উপর নির্মিত মুশাহিদ সেতুর সংযোগ রাস্তা নির্মানের জন্য তার বসতভিটা সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ করা হয়। তার বাড়ি নিয়ে হাইকোর্টে মামলা চলমান থাকায় ক্ষতি পূরণবাবদ কোন টাকা পয়সা পাননি ফলে তার জীবন হয়ে উঠে আরো দুর্বিষহ। আর কোন আশ্রয়স্থল না থাকায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনের লোকজন তার সন্তানদের সাফল্য এবং অসহায়ত্ব দেখে একটি পুরাতন সরকারী পরিত্যক্ত টিনসেডের ঘরে আশ্রয় দেন। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি সন্তানদেও লেখাপড়া বন্ধ করেননি।  এর কিছুদিন পর তার বড় ছেলে লেখাপড়া চলমান অবস্থায় বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করে। ছেলে পুলিশে যোগদানের পর তার কিছুটা স্বস্তি আসে এবং সংগ্রামের পথ চলায় সহযোগী হিসাবে ছেলে যথেষ্ট সহায়তা করতে থাকে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে মেজো ছেলে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি. ফিসারিজ এ অনার্স এবং মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন । বর্তমানে মেঝো ছেলে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় আছে এবং আরেক ছেলে সিলেট এমসি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন এবং বর্তমানে চাকরিপ্রত্যাশী। তার আরো এক ছেলে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করে। তার দুই মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে বর্তমানে তাদের স্বামীর সংসারে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল দেখে এলাকার অন্যান্য অভিভাবকরাও তাদের ছেলে মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। গ্রামের মানুষগুলো যখন তাদের সন্তানদের শিক্ষিত এবং আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তার কাছে পরামর্শের জন্য আসে তখন তিনি নিজেকে নিয়ে গর্ববোধ করেন।


সমাজ উন্নয়নে অবদান রাখছেন যে নারী:  

খাদিজা বেগমের পিতা একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি উজান বীরদল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে সফলতার সাথে ৫ম  শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি বীরদল এনএম একাডেমীতে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন ও সফলতার সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি দেখতে পান ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা সবদিক থেকে অনেক পিছেয়ে আছে ও অনগ্রসর। তাছাড়া বিদ্যালয়ের অনেক কর্মসূচিতে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদেরকে প্রাধান্য দেয়া হতো। তিনি তখন থেকে মনঃস্থির করেন এই অনগ্রসর নারী জাতির জন্য কিছু একটা করতে হবে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন একটি দেশ ও সমাজের উন্নয়নের জন্য নারী ও পুরুষকে সমানভাবে কাজ করতে হবে। নারীকে যদি ঘরে আটকে রাখা হয় তাহলে দেশ ও সমাজের উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত হবে। সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিনি ২০০৭ সালে কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি নির্বাচিত হন। কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি হওয়ার পর থেকে তিনি নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে নারীদের সচেতন করতে বিরাট ভূমিকা পালন করছেন। এছাড়াও নির্যাতিত মহিলাদের বিভিন্ন রকম আইনি সহায়তা প্রদানে কাজ করছেন। সমাজে বিভিন্ন প্রচলিত কুসংস্কার সম্পর্কে তিনি নারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নারী শিক্ষায় ব্যাপক উৎসাহ প্রদানে কাজ করেছেন। ২০১৮ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি উপজেলা নারী উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি নারী উন্নয়নে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। ২০১৯ সালে তিনি উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন।

সূত্র : দৈনিক উত্তর পূর্ব 

 



শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়