Friday, January 28

শিক্ষকতাকে শিল্পে পরিণত করেছিলেন হেডস্যার আব্দুর রহীম

 


কানাইঘাট নিউজ ডেস্ক :

হেডস্যার মোঃ আব্দুর রহীম উত্তর-পূর্ব সিলেটে শিক্ষা বিস্তারের অগ্রদূত। বৃহত্তর জৈন্তার শিক্ষার এই বাতিঘর তাঁর ৪৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে বেশ কিছু মানুষ তৈরী করে গেছেন যারা জনপ্রতিনিধিত্ব, জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে আজ বিভিন্ন সেক্টরে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছে। তিনি কেবলই একজন গুণী শিক্ষক কিংবা শিক্ষাবিদ ছিলেন না; একাধারে তিনি একজন সমাজচিন্তক, সংস্কারক ও নিখাদ ভাল মানুষ ছিলেন। শিক্ষকতাকে তিনি গতানুগতিকতার বাইরে নিজের সৃজনশীলতার মিশেলে এক শিল্পে পরিণত করেছিলেন। শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে তাঁর ভ‚মিকা যুগ যুগ জিইয়ে থাকবে, তিনি তাঁর অসামান্য অবদানের মধ্য দিয়ে অমর, অক্ষয় ও অব্যয় হয়ে থাকবেন। 


সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের চার দশকের প্রধান শিক্ষক বৃহত্তর জৈন্তায় ’হেডস্যার’ হিসেবে সমধিক পরিচিত মোঃ আব্দুর রহীম স্মরণে প্রকাশিত স্মৃতিগ্রন্থ ‘‘স্মৃতির পিঞ্জরে’’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভায় উঠে আসে কথাগুলো। হেডস্যার আব্দুর রহীম স্মৃতি সংসদ কর্তৃক আয়োজিত সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবস্ত ইউপি কমপ্লেক্সে শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি ২০২২) অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র এবং সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশিক আনোয়ার বাহার। 


সেন্ট্রাল জৈন্তার সাবেক ছাত্র এবং সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদির উপস্থাপনায় অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য (প্রবন্ধ) উপস্থাপন করেন ‘স্মৃতির পিঞ্জরে’ এর সম্পাদক এহসানুল হক জসীম। সেন্ট্রাল জৈন্তার অবসরপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক হোসাইন আহমদ (বিএসসি স্যার) এর নেতৃত্বে অনুষ্ঠানে ‘স্মৃতির পিঞ্জরে’ এর আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হয়। 


হেডস্যার আব্দুর রহীম ও স্মৃতিগ্রন্থের উপর আলোচনা করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আতিউল্লাহ, সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমদ, গোয়াইনঘাট সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল মোঃ ফজলুল হক, কারিগরী শিক্ষা অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক রেহান উদ্দিন। আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্য দেন জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল আহমদ, সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, জৈন্তাপুর তৈয়ব আলী ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল এম. মফিজুর রহমান চৌধুরী, ইমরান আহমদ মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক শাহেদ আহমদ, ব্যাংকার সাইফুল ইসলাম, দরবস্ত ইউপি চেয়ারম্যান বাহারুল আলম বাহার, কানাইঘাটের ৭ নং দক্ষিণ বাণীগ্রাম ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ লোকমান উদ্দিন, দৈনিক আলোকিত সিলেটের নির্বাহী সম্পাদক মোহাম্মদ গোলজার আহমদ, জৈন্তাপুর উপজেলা যুবলীগের আহ্ববায়ক আনোয়ার হোসন, যুগ্ম আহবায়ক কুতুব উদ্দিন, পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান এমএ রহীম, কবি সরওয়ার ফারুকী, জৈন্তাপুর প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ফয়েজ আহমদ প্রমুখ। 


ড. আতিউল্লাহ বলেন, শিক্ষকতার মতো পেশাকে যারা ব্রত হিসেবে নেন, তারা প্রকৃতঅর্থে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে অভিহিত হন। হেডস্যার আব্দুর রহীমের কাছে শিক্ষকতা কেবলই একটি পেশা ছিল না, তাঁর কাছে এটা ছিল ব্রত এবং জৈন্তা অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ। শিক্ষকতাকে তিনি শিল্পে পরিণত করেছিলেন বলে মানুষ গড়ার কারিগরই শুধু হয়ে উঠেননি; তিনি হয়ে উঠেছিলেন বৃহত্তর জৈন্তার শিক্ষার বাতিঘর।  


হেডস্যারের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের সহকর্মী হোসাইন আহমদ (বিএসসি স্যার) বলেন, সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা সকল শিক্ষক টিমওয়ার্ক করেছি। আমাদের টিমের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সুযোগ্য প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুর রহীম। তিনি তাঁর কর্মগুণে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন। 


বাকি আলোচক ও বক্তাদের বেশির ভাগই হেডস্যার ও সেন্ট্রাল জৈন্তার সাবেক ছাত্র। তারা বলেন, হেডস্যার আব্দুর রহীম আমাদেরকে শিখিয়েছেন, শিখতে উৎসাহ দিয়েছেন, আত্মবিশ্বাস উন্নত করেছেন, স্বপ্ন দেখিয়েছেন, গর্বিত হতে শিখিয়েছেন। আজ তাঁর অনুপস্থিতি জৈন্তাবাসীর চিন্তার জগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছে তা অপূরণীয়। 

সাব্বির আহমদ বলেন, হেডস্যার আব্দুর রহীমের প্রধান অর্জন হচ্ছে, তিনি একটি আদর্শ টিম গঠন করেছিলেন এবং সেই টিমের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একাধারে চল্লিশ বছর। তাঁর সুদক্ষ নেতৃত্বে সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয় খ্যাতির শিখরে আরোহন করায় দুর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে চলে আসতো। হেডস্যারের কারণে সেন্ট্রাল জৈন্তার প্রতি শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট ছিল। আমাদের অনেকের আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে অন্যান্য শিক্ষকের পাশাপাশি আব্দুর রহীম স্যারের অবদান অনেক বেশি।


মোঃ ফজলুল হক বলেন, দক্ষতায় হেডস্যার আব্দুর রহীমের দ্বারে কাছে কেউ নেই। তিনি ক্লাসেই শিখিয়ে দিতেন। স্যারের ক্লাস শেষ হলে আমরা আবার পরবর্তী ক্লাসের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। তাঁর ক্লাসে বোরিং ফিল করতাম না; বরং অনুপ্রেরণা পেতাম। শিক্ষকের কাজ অনুপ্রাণিত করা। হেডস্যার আমাদেরকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। 


মূল বক্তব্যে এহসানুল হক জসীম বলেন, হেডস্যার আব্দুর রহীম ছিলেন একজন সজ্জন বিদ্বান। ছিলেন আপাদমস্তক একজন ভদ্রলোক, বিনয়ী, পÐিত ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী। আজ যখন সংকীর্ণতা ও অজ্ঞতার দর্পে ফুঁসছে সমাজ; তখন প্রাজ্ঞ, মুক্ত, অপার একজন মানুষের চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি। 


তিনি তাঁর প্রবন্ধে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেন। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, সেন্ট্রাল জৈন্তা উচ্চ বিদ্যালয়ে হেডস্যার আব্দুর রহীমের নামে কোন ভবনের নামকরণ করা; অন্য কোথাও কোন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ কিংবা প্রতিষ্ঠানের কোন ভবনের নাম কিংবা হলরুমের নামকরণ করা; বৃহত্তর জৈন্তায় যেসব গুণীজন আছেন তাদের মধ্যে যাদের শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে অবদান আছে তাদেরকে মূল্যায়ন করতে ‘হেডস্যার পদক’ চালু করা;  হেডস্যার আব্দুর রহীম স্মৃতি সংসদ যেন এই গুণীজনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে; শিক্ষাবৃত্তি চালু করা; এবং শিক্ষা বিস্তারে হেডস্যার আব্দুর রহীমের ভূমিকা নিয়ে কোন বিশ^বিদ্যালয়ে এম.ফিল বা পিএইচ.ডি গবেষণায় পৃষ্ঠপোষকতা দান করা। 


সভাপতির বক্তব্যে ডা. আশিক আনোয়ার বাহার বলেন, হেডস্যার আব্দুর রহীমকে পেয়েছি দুটি সত্তা হিসেবে। নিজেকে ধন্য মনে করি একজন আদর্শ, সৎ ও নিষ্ঠাবান পিতার সন্তান হিসেবে; নিজেকে আরো ধন্য মনে করি একজন শ্রেষ্ঠ শিক্ষককে পরিবারের গÐির বাইরে স্কুল জীবনেও পেয়েছি সরাসরি শিক্ষক হিসেবে। হেডস্যারের এই সুযোগ্য সন্তান আরো বলেন, মরহুম আব্দুর রহীম শিক্ষকতাকে একটি গতানুগতিক চাকুরি কিংবা শুধু জীবন-জীবিকা অর্জনের একটি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেননি। তিনি এটাকে একটা নেশা হিসেবে এবং সে সময়ে তুলনামূলক পশ্চাৎপদ জৈন্তা অঞ্চলকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।


কামাল আহমদ বলেন, এক সময় জৈন্তা অঞ্চল তুলনামূলক পশ্চাৎপদ ছিল। এই অঞ্চলকে শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে নেওয়া হেডস্যারের ব্রত ছিল, যা তাঁকে অন্য পেশার হাতছানি উপেক্ষা করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসে। নিরলস পাঠদান এবং বিদ্বৎসমাজে তাঁর সচলতা তাঁকে যুগ যুগ জিইয়ে রাখবে। 


জয়নাল আবেদীন বলেন, হেডস্যার তাঁর মেধা, শ্রম, সাধনা এবং জীবন ও যৌবনের সবটুকু দিয়ে সেন্ট্রাল জৈন্তাকে মনের মতো করে সাজিয়েছেন। ফলে সেন্ট্রাল জৈন্তা হয়ে ওঠে অপ্রতিদ্ব›িদ্ব প্রতিষ্ঠান । 


‘স্মৃতির পিঞ্জরে’ সম্পাদনা করেন এহসানুল হক জসীম। এটি কোন গতবাঁধা সংকলন নয়। হেডস্যার মোঃ আব্দুর রহীমের জীবনের একটি স্কেচ এবং সেন্ট্রাল জৈন্তাকে পেছন থেকে ফিরে দেখা। গতানুগতিক স্মৃতিচারণা নয়, বাণী নেই। তথ্য-নির্ভর ও প্রাসঙ্গিক কয়েকটি লেখার মলাটবদ্ধ রূপ। এই স্মৃতিগ্রন্থে ২০ জনের লেখা স্থান পেয়েছে। এই লেখকদের বেশির ভাগ সেন্ট্রাল জৈন্তার সাবেক ছাত্র, যারা এখন স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। হেডস্যারকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত এই স্মৃতিগ্রন্থ কেবলই হেডস্যারের জীবনালেখ্য নয়; এখানে চলে এসেছে সেন্ট্রাল জৈন্তা প্রতিষ্ঠার ইতিহাসও। বৃহত্তর জৈন্তার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি, জৈন্তায় শিক্ষা বিস্তারে আরো যাদের অবদান রয়েছে তাদের অনেকের কথা এবং আরো নানা দিক চলে এসেছে এই গ্রন্থে। (বিজ্ঞপ্তি)


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়