ষাটের দশক থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ দশক এ দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক। সেলুলয়েডের ফিতায় আবহমান বাঙালির আনন্দ-বেদনা-ভালোবাসার অনন্য রূপকার তিনি। অনন্ত আকাশের হাতছানিকে আলিঙ্গন করে জীবনের সব গান শেষ করে ২০১৭ সালের আজকের এই দিনে নায়করাজ রাজ্জাক নীল আকাশে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন। কিন্তু রাজ্জাক বেঁচে আছেন, থাকবেন বাঙালির হৃদয়রাজ্যের রাজা হয়ে।
নায়করাজ রাজ্জাকের দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবসে ডেইলি বাংলাদেশ পরিবারের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
রাজ্জাক ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মুকুটবিহীন
সম্রাট। অভিনয় দক্ষতা আর বিশাল জনপ্রিয়তার কারণে তিনি ছিলেন রুপালি পর্দার
রাজা নায়করাজ রাজ্জাক। নায়করাজ উপাধিটি দিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্র পত্রিকা
‘চিত্রালী’র সম্পাদক আহমদ জামান চৌধুরী। তার ভুবন ভোলানো হাসি, রোমান্টিক
ম্যানারিজম, নিষ্পাপ দৃষ্টি বাংলা চলচ্চিত্রের তিন প্রজন্মের দর্শকদের
মুগ্ধ করেছেন।
জন্ম ২৩ জানুয়ারি ১৯৪২, দক্ষিণ কলকাতার
নাকতলায়। শৈশবেই বাবা আকবর হোসেন এবং মা নিসারুননেসাকে হারান। তিন ভাই, তিন
বোনের সংসারে বেশি সাপোর্ট পেয়েছেন তার মেজ ভাই আবদুল গফুরের। ইচ্ছা ছিল
ফুটবলার হওয়ার, ভালো গোল রক্ষকও ছিলেন। রীতিমতো হায়ার করে নিয়ে যাওয়া হতো
তাকে। তার পড়াতেই থাকতেন ছবি বিশ্বাস, আবৃত্তি শেখাতেন শিশু কিশোরদের। সে
দলেও ছিলেন রাজ্জাক। কলকাতার খানপুর হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়
শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা নাটক ‘বিদ্রোহীতে’ গ্রামীণ কিশোর চরিত্রে অভিনয়ের
মধ্য দিয়েই নায়করাজের অভিনয়ে যাত্রা শুরু।
পাড়ার শক্তিসংঘ ক্লাবে ‘ইহুদি’ নাটকে অভিনয়
করলেন। এরপর তরুণতীর্থ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীতে। ছবি বিশ্বাস ছিলেন এই ক্লাবের
সভাপতি। সেখানে নাট্য পরিচালক ছিলেন পীযুষ বোস। রাজ্জাক অভিনয়ে গুরু মানতেন
পীযুষ বোসকে, নায়ক হিসাবে তার আইডল ছিলেন উত্তম কুমার।
১৯৬২ সালে খায়রুন্নেসা লক্ষ্মীকে বিয়ে করেন
তিনি। ১৯৬৪’র দাঙ্গার পর ভাবলেন বোম্বে চলে যাবেন। ফেরালেন পীযুষ বোস,
বললেন ‘ক্যারিয়ার গড়তে হলে পূর্ব পাকিস্তানে যাও।’ ১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল
স্ত্রী লক্ষ্মী এবং শিশুপুত্র বাপ্পাকে নিয়ে শরণার্থী হয়ে তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানে আসেন। সঙ্গে পীযুষ বোসের দেয়া একটি চিঠি ও পরিচালক আবদুল জব্বার
খান ও শব্দগ্রাহক মনি বোসের ঠিকানা। ঢাকার কমলাপুরে ৮০ টাকা ভাড়ায় একটি
বাসায় উঠেছিলেন। আবদুল জব্বার তাকে ইকবাল ফিল্মসে কাজ করার সুযোগ দেন।
১৯৬৪ সালে ‘উজান’ চলচ্চিত্রে কামাল আহমদের
সঙ্গে সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন। তখনো সংগ্রামের জীবন। তৎকালীন
পাকিস্তান টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামক ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে দর্শকদের
কাছে জনপ্রিয় হন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি আবদুল জব্বার খানের সঙ্গে
সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। সালাউদ্দিন প্রোডাকসন্সের তের
নম্বর ফেকু ওস্তাগর লেন চলচ্চিত্রে ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করে সবার কাছে
নিজ মেধার পরিচয় দেন রাজ্জাক। পরবর্তীতে কার বউ, ডাক বাবু, আখেরি স্টেশনসহ
আরো বেশ কিছু ছবিতে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
পাকিস্তান টেলিভিশনের খবর পাঠক হিসেবে
ইন্টারভিউ দিয়ে টিকে গিয়েছিলেন। কিন্তু অভিনেত্রী রেশমার স্বামী জামান আলী
খান তাকে অভিনয়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে বলেন। সে সময় জহির রায়হান শুরু করেন
লোক কাহিনী নিয়ে বেহুলা ছবির নির্মাণ কাজ। জহির রায়হান রাজ্জাককে তার ছবির
নায়ক লখিন্দর হিসেবে নিলেন। তার বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় ছিলেন কোহিনুর
আক্তার সুচন্দা। ১৯৬৬তে মুক্তি পেয়ে ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
বেহুলা ছবিটি করে পেয়েছিলেন পাঁচ হাজার টাকা। সেই থেকে বড় পর্দায় নায়ক
হিসেবে তঁর পথচলা শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
ঢাকার সিনেমা হলগুলোতে তখন পাকিস্তান,
ভারতীয় ছবির দাপট, সেখানকার বড় শিল্পীরা তখন দর্শক মাতিয়ে আছেন। এদের ছবির
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করলো ঢাকার নির্মাতাদের ছবি। দেশ স্বাধীন
হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশির ভাগ ছবির নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। দুই ভাই,
আবির্ভাব, বাঁশরি, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নিচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল,
দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধুর মিলন ইত্যাদি ছবির
সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক।
ঢাকায় এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫৭ সালে।
নায়করাজ অভিনয় শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। বাংলা চলচ্চিত্রের শৈশব থেকে যৌবন
যেন তার হাত ধরেই পথ চলেছে। তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে তিনি বাংলার নারী হৃদয়ে
স্বপ্নের নায়ক হয়ে উঠেছেন। তার অভিনীত চরিত্রগুলো বাস্তবজীবনে আদর্শের
প্রতীক। যে কারণে তিনি মায়ের কাছে ছেলের মতো, ভাইয়ের কাছে বোন, আর যুবতী
নারীর কাছে আরাধ্য প্রেমিকের মতো। বাংলা চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে বিরাজ
করেছেন প্রায় অর্ধ শতাব্দী। প্রেমের ছবির পাশাপাশি অ্যাকশন ছবিতেও ছিলেন
সমান সফল। প্রযোজক হিসেবে নায়ক রাজের পথচলা ‘রংবাজ’ ছবিটি প্রযোজনার মধ্য
দিয়ে। ছবিটিতে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের সার্বিক অবস্থার কথা চিন্তা করে
তার প্রেমিক রাজের ইমেজ থেকে নিজেকে বের করে তৈরি করলেন নতুন চরিত্র। এ
ছবিতেও তিনি সুপার হিরো।
চলচ্চিত্রে সমাজ ও সময়ের প্রয়োজনে চরিত্রের
পরিবর্তন ঘটিয়েও কী করে সুপার হিরো হওয়া যায় তা তিনিই দেখিয়ে গেছেন। এরপর
করলেন ‘বেইমান’। ১৯৭৭ সালে ‘অনন্ত প্রেম’ ছবি দিয়ে পরিচালক হিসেবে তার
প্রথম আত্মপ্রকাশ।
অভিনয় পাগল মানুষটি নিজেই বলতেন, আমার
প্রেম, আমার ভালবাসা, আমার সবকিছু অভিনয় আর চলচ্চিত্রকে ঘিরে। এ ছাড়া আমি
আর কিছু জানি না, পারি না। তিনি তার কর্মময় জীবনে প্রায় ৫০০টি বাংলা ও
উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। পরিচালনা করেছেন ১৬টি চলচ্চিত্র। প্রযোজনা
করেছেন ২০টি ছবি।
তার উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে- কি যে
করি, অশিক্ষিত, বড় ভাল লোক ছিল, চন্দ্রনাথ, যোগাযোগ, ছুটির ঘণ্টা, বেইমান,
অনির্বাণ, ঝড়ের পাখি, আলোর মিছির, এখানে আকাশ নীল, অবাক পৃথিবী, বদনাম, আমি
বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে, উত্তর ফাল্গুনী
উল্লেখযোগ্য।
পুরস্কার পেয়েছেন অসংখ্যবার। ২০১৫ সালে
বাংলাদেশ সরকার সংস্কৃতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন তাকে স্বাধীনতা পদকে
ভূষিত করে। এ ছাড়া ১৯৭৬, ১৯৭৮, ১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৮ সালে মোট ৫ বার শ্রেষ্ঠ
অভিনেতার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। ২০১৩ সালে
চলচ্চিত্র অবদানের জন্য তাকে আজীবন সম্মাননা দেয়া হয়। তিনি ২০১৪ সালে মেরিল
প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কারসহ আরো বেশ কয়েকটি আজীবন সম্মাননা
পুরস্কার পান। চলচ্চিত্রের বাইরে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত
হিসেবে কাজ করেছেন।
সূত্র:
ডেইলি বাংলাদেশ
খবর বিভাগঃ
বিনোদন
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়