Tuesday, March 19

হাঁচি দেয়ার আদব ও ইসলামের শিক্ষা

মাওলানা ওমর ফারুক:

যখন কোনো ব্যক্তির হাঁচি আসে তখন তার ব্যাপারে হুজুর (সা.) এর শিক্ষা হলো, হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলবে। আর যে ব্যক্তি পাশে বসে শুনবে তার ‘يرحمك الله’ বলা উচিত, অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা তোমার উপর রহম করুন। এই ‘يرحمك الله’ শব্দটিকে বলা হয় ‘تشميت’। এটা আরবি শব্দ। এর অর্থ কাউকে তার কথার উত্তরে দোয়া দেয়া যে, সে সঠিক পথে আছে।

হাই অলসতার আলামত:
রাসূল (সা.) এর শিক্ষা হলো হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলবে এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। আসলে প্রতিটি কাজই মহান আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়ার দাবীদার। কিন্তু হাদিস শরীফের মধ্যে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেছেন (التثاؤب من الشيطان والعطاس من الرحمن) অর্থাৎ হাই তোলা শয়তানের প্রভাবে হয়ে থাকে এবং হাঁচি আল্লাহ তায়ালার রহমতের একটি অংশ। তার কারণ এই যে, হাই অলসতার সময় এসে থাকে এবং যখন কেউ হাই তোলে তখন বুঝা যায় যে, তার শরীরে আলসেমী ভর করেছে। আর অলসতা শয়তানের প্রতিক্রিয়ায় হয়ে থাকে, যা মানুষকে ভালো কাজ এবং কল্যাণকর আমল থেকে বিরত রাখে। যদি মানুষ ওই অলসতার কারণে ভালো কাজ ছেড়ে দেয় তাহলে অবশেষে সে এই হয় যে, সব রকম কল্যাণ থেকে বিরত থেকে যায়। এই জন্য হুজুর (সা.) এর শিক্ষা হলো ওই অলসতাকে দূর করে দাও, যার কারণে ভালো কাজের মধ্যে আলসেমী আসে। অলসতার মোকাবিলা করে কল্যাণের কাজে লেগে যাও।
রাসূল (সা.) কর্তৃক অক্ষমতা ও অলসতা থেকে আশ্রয় চাওয়া:
এর জন্য হুজুর (সা.) এই দোয়া করেন  (اللهم إني أعوذ بك من العجز والكسل) অর্থ হে আল্লাহ! আমি অক্ষমতা ও অলসতা থেকে আপনার নিকট পানাহ বা আশ্রয় চাচ্ছি। অলসতা অত্যন্ত খারাপ জিনিস। এ জন্য তা থেকে বেঁচে থাকা উচিত। আর যদি কাউকে অলসতা পেয়ে বসে তাহলে তার এ ছাড়া আর কোনো ওষুধ নেই যে, অলসতার মোকাবেলা করে তা দূর করতে হবে। যেমন, অলসতার কারণে মন চায় যে, কাজ না করে ঘরে বসে থাকি। তাহলে তার ওষুধ এই যে, মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে ঘর থেকে বের হয়ে যাও এবং অলসতার মোকাবিলা করো। আর হাই তোলা সেই আলসেমীর নিদর্শন হওয়ার কারণে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন হাই শয়তানের প্রভাবের করণে হয়ে থাকে।
হাঁচি আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হয়:
হাঁচি সম্পর্কে হুজুর (সা.) বলেছেন যে, এই হাঁচি ‘رحمن’ এর পক্ষ থেকে হয়, অর্থাৎ আল্লাহ জাল্লা শানুহুর রহমতের একটি নিদর্শন। এক ধরণের হাঁচি তো হলো এই, যা সর্দি-কাশি ও ঠান্ডার কারণে আসতে শুরু করে এবং ধারাবাহিকভাবে চলতেই থাকে, এটা তো রোগ, কিন্তু যদি একজন মানুষ সুস্থ থাকে সর্দি-কাশি-ঠান্ডা জাতীয় কোন রোগ তার নেই, এতদ্বসত্তেও তার হাঁচি আসে, তখন তার ব্যাপারে হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন যে, তা রহমানের পক্ষ থেকে রহমতের আলামত।
তাই চিকিৎসকরা লিখেছেন যে, কখনো মানুষের শরীরে কোনো রোগব্যাধির আক্রমণের আশংকা দেখা দেয় তখন হাঁচি ওই আক্রমণকে প্রতিহত করে দেয়। হাঁচি যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রহমতের একটি নিদর্শন তা তো উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝে আসল। যা প্রকাশ্য, অন্যথায় এর মধ্যে যা বাতেনী রহমত রয়েছে তা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন, যেহেতু হাঁচি আল্লাহ রহমতসমূহের মধ্যে একটি নিদর্শন। এর জন্য হুযুর (সা.) বলেছেন, যখন কারো হাঁচি আসে তখন সে যেন ‘الحمدلله’ বলে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে।
আল্লাহ তায়ালাকে ভুলো না:
এই বিধি-বিধানের মাধ্যমে প্রতিটি পদক্ষেপে এই শিক্ষা দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালাকে ভুলো না এবং আল্লাহ তায়ালার নিকট সর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তন কর। এবং সকল সময়, অবস্থা ও স্থান সম্পর্কেই বলা হয় যে, ওই সময় এই দোয়া পড়ে নাও, অমুক সময় এই দোয়া পড়ে নাও। এ দোয়াগুলো এর জন্য বলবে যেন আমাদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত আল্লাহ তায়ালার যিকির দ্বারা মুল্যবান হয়ে যায় এবং সমস্ত অবস্থার পরিবর্তনের সময় আল্লাহ তায়ালার দিকে ধাবিত হওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। সকল ইবাদত, সকল মুজাহাদা, যাবতীয় পরিশ্রম, তাসাওউফ এবং সুলুকের সারমর্ম হলো আল্লাহ তায়ালার দিকে প্রত্যাবর্তন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায় এবং যার দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সম্পর্ক কায়েম হয়, সেই আমলগুলো অভ্যাসে পরিণত করার জন্যই নবী (সা.) বিভিন্ন দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন- বলেছেন হাঁচি দিয়ে বলো ‘الحمدلله’ ।
এক যামানা এমন ছিল যখন এই সুন্নাত অর্থাৎ হাঁচির পরে ‘الحمدلله’ বলা মুসলমানদের স্বাভাবিক চালচলনের অন্তর্গত হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে শিখানো এবং বলার প্রয়োজন ছিল না। সেই যামানায় এই কল্পনাও ছিল না যে, যদি কোনো মুসলমানের হাঁচি এসে যায় তখন সে ‘الحمدلله’ বলবে না। কেন না ছোটবেলা থেকেই তাদের শিক্ষা দীক্ষা দিয়ে এভাবেই গড়ে তোলা হয়েছিল যে, এর ব্যতিক্রম হতো না। কিন্তু এখন এই জিনিস তথা শিক্ষা দীক্ষা বন্ধ হতে চলেছে। ফলশ্রুতিতে এই সুন্নাত মুর্দা হতে চলেছে। তাই এই সুন্নাতকে জিন্দা করার প্রয়োজন। এই জন্য হাঁচি আসার সঙ্গে সঙ্গে ‘الحمدلله’ বলতে যত্নবান হও।
হাঁচিদাতার উত্তর দেয়া ওয়াজিব:
দ্বিতীয় আলোচ্য বিষয় এই, যে ব্যক্তি হাঁচিদাতার নিকটে বসা থাকে এবং সে শুনে যে, হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলেছে, তাহলে শ্রবণকারী ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব হলো জওয়াবে ‘يرحمك الله’ বলা। এর নাম ‘تشميت’ আর এ জওয়াব দেয়া শুধুমাত্র সুন্নাত বা মুস্তাহাব নয় বরং ওয়াজিব। এই কারণে যদি কোনো ব্যক্তি ‘يرحمك الله’ এর মাধ্যমে জওয়াব না দেয় তাহলে তার ওয়াজিব তরক করার গুনাহ হবে। অবশ্য ইহা তখনই ওয়াজিব হবে যখন হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলবে। আর যদি হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ না বলে তাহলে শ্রবণকারীর উপর ‘يرحمك الله’ বলা ওয়াজিব নয়। অবশ্য আল্লাহ তায়ালা তা সহজ করে দিয়েছেন। প্রত্যেক শ্রবণকারীর জওয়াব দেয়া জরুরি নয়, বরং শ্রবণকারী যদি দশ জন হয় এবং তাদের মধ্য থেকে একজনে ‘يرحمك الله’ বলে দেয়, তাহলে সকলের পক্ষ থেকে ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্ত মজলিসের মধ্যে কেউ যদি ‘يرحمك الله’ না বলে তাহলে মজলিসের সমস্ত লোক ওয়াজিব ছেড়ে দেয়ার কারণে গুনাহগার হবে।
এটা মুসলমানের একটি হক:
আমরা একটু ভেবে দেখি নিজের অল্প জীবনের মধ্যে এই ওয়াজিব থেকে কেমন গাফেল হয়ে থাকি। প্রথমত: হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলে না। এবং যদি সে বলে ‘الحمدلله’ তাহলে যে শুনলো সে ‘يرحمك الله’ এর মাধ্যমে উত্তর দেয়ার ক্ষেত্রে এই পরিমাণ গুরুত্ব দেয় না যতটুকু গুরুত্ব দেয়া উচিত। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হাদিসে ইরশাদ করেছেন যে, ‘تشميت’ তথা হাঁচিদাতার জবাব দেয়া এক মুসলমানের জন্য অন্য মুসলমানের হক। এবং তার দায়িত্বে তা ওয়াজিব।
কতবার উত্তর দেয়া ওয়াজিব:
হুজুর (সা.) এই ভদ্রতা শিখিয়েছেন যে, যদি একবার হাঁচি আসে তাহলে উত্তর দেয়া ওয়াজিব। আর যদি দ্বিতীয়বার হাঁচি আসে তাহলে উত্তর দেয়া সুন্নাত। এবং তৃতীয়বার উত্তর দেয়াও সুন্নাত এবং প্রতিদান ও সওয়াবের কারণ। এর পরও যদি হাঁচি আসে তাহলে উত্তর দেয়া ওয়াজিবও না সুন্নাতও না। অবশ্য যদি কোনো ব্যক্তি উত্তর দিতে চায় দিবে। ইনশাআল্লাহ এর পরও সওয়াব হবে।
রাসূল (সা.) এর আমলের পদ্ধতি:
হাদিস শরীফে এসেছে যে, একটি মজলিসের মধ্যে হুজুর (সা.) আগমন করলেন। একজন সাহাবীর হাঁচি দিয়ে ‘الحمدلله’ বললেন। হুজুর (সা.) উত্তর দিলেন ‘يرحمك الله’। দ্বিতীয়বার হাঁচি দিলে হুজুর (সা.) তার উত্তর দিলেন ‘يرحمك الله’। তৃতীয়বার আবার হাঁচি দিলে হুজুর (সা.) তৃতীয়বারও উত্তর দিলেন ‘يرحمك الله’। যখন চতুর্থবার তার হাঁচি আসল তখন হুজুর (সা.) বললেন (رجل مزكوم) অর্থাৎ তার ঠান্ডা লেগেছে। এবং ওই বার তিনি উত্তর দিলেন না।
এই হাদীসের মাধ্যমে রাসূল (সা.) এই মাসআলা বলে দিয়েছেন যে, তৃতীয়বারের পর উত্তর দেয়ার প্রয়োজন নেই। দেখ! শরীয়ত আমাদের জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য কতো সুবিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে। যাতে করে এটা না হয় যে, মানুষ শুধুমাত্র ওই কাজের মধ্যে লেগে থাকবে এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু এ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।
এই উত্তর দেয়া কখন ওয়াজিব:
দ্বিতীয় মাসআলায় বলা হয়েছে যে, ‘يرحمك الله’ এর মাধ্যমে উত্তর দেয়া ওই সময় ওয়াজিব যখন হাঁচিদাতা ‘الحمدلله’ বলবে। যদি না বলে তাহলে উত্তর দেয়া ওয়াজিব নয়। কিন্তু উত্তর দেয়া উত্তম। যাতে করে হাঁচিদাতার শিক্ষা হয়ে যায় যে, আমার ‘الحمدلله’ বলা উচিত।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়