Wednesday, January 20

মসজিদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা

যুবায়ের আহমাদ
ছোট সোনা মসজিদ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : মসজিদটি 'সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন' বলে আখ্যায়িত। প্রধান প্রবেশপথের উপরিভাগে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুযায়ী জনৈক মজলিস-ই-মাজালিস, মজলিস মনসুর ওয়ালি মুহম্মদ বিন আলী কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালের (হি. ৮৯৯-৯২৫/ ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) কোনো একসময় মসজিদটি নির্মিত। অলঙ্করণের ক্ষেত্রে যে সোনালি গিল্টির ব্যবহার থেকে সোনা মসজিদ নামকরণ হয়েছে তা এখন আর নেই

আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ মসজিদ। মসজিদ আল্লাহর ঘর। পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র স্থান। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক। ইসলামী সমাজ ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু। ইসলামের সোনালি যুগে মুসলমানদের শিক্ষালয়, বিচারালয়, পরামর্শ, রাসুলে করিম (সা.) এর ইসলামী রাষ্ট্রের সচিবালয়ই ছিল মসজিদ। মসজিদ পরিচালনায় রাসুলে করিম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি অনুসরণ করা উচিত আমাদের।


মসজিদ পরিচালনা : মসজিদ পরিচালনা কারা করবে তা পবিত্র কোরআনুল কারিমে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, 'আল্লাহর মসজিদ আবাদকারী (তত্ত্বাবধায়ক ও খাদেম) তো তারাই হবে, যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করেন, নামাজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জাকাত দেন আর আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করেন না।' (সূরা তওবা : ১৮)। এ আয়াতে মসজিদের তত্ত্বাবধানে থাকার অত্যাবশ্যকীয় যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া মসজিদ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ও উন্নয়ন কাজে যারা নিয়োজিত হবেন বা যাদের নিয়োজিত করা হবে তাদের কতগুলো মানবীয় ও সামাজিক গুণাবলিও থাকতে হবে। ভালো আবেদ হওয়া আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া কিন্তু ভিন্ন জিনিস। মসজিদের পরিচালনায় যারা থাকবেন তাদের ভালো ইবাদতকারী হওয়ার পাশাপাশি ভালো সংগঠকও হওয়া প্রয়োজন।


মসজিদের দান সংগ্রহ : ইসলামী রাষ্ট্রে মসজিদের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্রের। আমাদের দেশের মসজিদগুলো দশের টাকায় পরিচালিত হয়। মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন আছে। কিন্তু অর্থ সংগ্রহে এমন কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, যা রীতিমতো অপমানজনক। বিভিন্ন স্থানে চোখে পড়ে পেশাদার দান সংগ্রহকারী। রাস্তার পাশে মাইক নিয়ে গলা ফাটিয়ে দান চেয়ে থাকেন, গাড়িতে রসিদ বই নিয়ে মানুষের কাছে টাকা চান, কখনও কখনও দেখা যায় গাড়িতে যাত্রীদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় একটি চিরকুট। যাতে লেখা থাকে দানের আবেদন। অমুসলিমদের কাছেও হাত পাতা হয় কোথাও কোথাও। ইসলামের লেবাস কিংবা অনুভূতিকে পুঁজি করে এভাবে অর্থ সংগ্রহ করে ইসলামকে ছোটই করা হচ্ছে। নষ্ট করা হচ্ছে ইসলামের ভাবমূর্তি। বিদ্বেষীদের ইসলামকে 'খয়রাতি' বলার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। অথচ ইসলাম ভিক্ষা কিংবা কারও কাছে হাত পাতার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে। হজরত সামুরা ইবনে জানদুব (রা.) থেকে বর্ণিত মহানবী (সা.) বলেছেন, 'ভিক্ষাবৃত্তি হলো ক্ষতস্বরূপ; এর দ্বারা মানুষ মুখম-লকে ক্ষতবিক্ষত করে।' (আবু দাউদ)। অন্য হাদিসে হজরত হাকিম ইবনে হিজাম (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম।' (বোখারি : ২/৫১৯)। পেশাদারদের আদায় করা দানের সিংহভাগই চলে যায় আদায়কারীর পকেটে। এভাবে অর্থ আদায়ের বাণিজ্যিক পদ্ধতির ব্যাপারে কমিটিগুলোর সজাগ হওয়া প্রয়োজন।


কখনও দেখা যায় মসজিদের জন্য রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পাতা হয়, অথচ ওই মসজিদেই এসি লাগানো আছে। মসজিদের টয়লেটগুলোতেও টাইলস লাগানো থাকে। অথচ রাসুলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক নির্মিত মসজিদে নববির দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের, খুঁটি ছিল খেজুরের। রাস্তায় মানুষের কাছে হাত পেতে মসজিদের টয়লেটে টাইলস লাগানোর কী প্রয়োজন? ইবাদতের জন্য আরামদায়ক বানানো অথবা সৌন্দর্য বর্ধন দূষণীয় নয়। তা হবে মহল্লাবাসীর সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে। যেখানে সেখানে মানুষের কাছে হাত পেতে মসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের যৌক্তিকতা কোথায়?


মসজিদের অর্থ ব্যয় : মসজিদে অবকাঠামোগত সৌন্দর্যের প্রয়োজন আছে। মসজিদকে মুসলি্লদের জন্য আরামদায়কও করা যায়। তবে মুসলি্লদের তাকওয়া বৃদ্ধির ব্যাপারে উদাসীন হয়ে শুধু অবকাঠামোগত নির্মাণের দিকে গুরুত্ব দেয়া ঠিক নয়। সূরা তওবার ১৮নং আয়াতের ব্যাখ্যায় এসেছে, 'মসজিদ আবাদ বলতে শুধু এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্যবর্ধনকেই বোঝায় না, বরং তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সব ধরনের শিরক ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখাও বোঝায়।' (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৮/৬৬০)। অনেক সময় দেখা যায় মসজিদের টাকায় অপব্যয়, লাইটিং, আলোকসজ্জা ইত্যাদিতেও প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। ইবাদতের মাধ্যমে তা আবাদ করার চেয়ে নির্মাণের ব্যাপারেই আমরা বেশি মনোযোগী। এ নিয়ে গর্বও করা হয়। এটি কেয়ামতের আলামত বলে হাদিসে বর্ণিত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, 'যতদিন লোকেরা মসজিদ (নির্মাণ ও কারুকার্য) নিয়ে গর্ব না করবে ততদিন কেয়ামত হবে না।' (আবু দাউদ : ১/২৫০)।


ইমামের সম্মানী ও আবাসন : শহুরে এলাকার অনেক মসজিদে দোকানপাট আছে। মসজিদের আন্ডার গ্রাউন্ডে আছে বিশাল মার্কেট। মাসে কোটি টাকা আয়। কিন্তু খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিনের সম্মানী খুবই কম। উন্নত কার্পেট, লাইটিং, টাইলস, এয়ার কন্ডিশনের মতো আয়েসী খাতগুলোতে অর্থব্যয়ের প্রতিযোগিতা থাকলেও ইমাম-মুয়াজ্জিনের একান্ত প্রয়োজন মেটানোর মতো সম্মানী দিতে কৃপণতার প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়। তাদের মনোভাবটা এমন, মসজিদের অন্যসব খরচই প্রয়োজনের, শুধু ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানীটাই অপ্রয়োজনের খাত। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত সম্মানী দিতে অবহেলা করায় অনেক মসজিদ গবেষণাধর্মী খুতবায় পারদর্শী যোগ্য খতিব থেকেও মাহরুম হচ্ছে।


আলোকসজ্জা এবং এয়ার ফ্রেশনারে বছরে হাজার হাজার টাকা খরচ করলেও মন বাধা দেয় না; কিন্তু বছর শেষে ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানী বাড়ানোর প্রসঙ্গ এলেই যেন কমিটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মসজিদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের এ সময়ে ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানীর উন্নয়নও যে প্রয়োজন আছে, তা মসজিদ তত্ত্বাবধায়কদের ভেবে দেখা উচিত।


ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মসজিদের ব্যয়ের ব্যাপারেও কেন অপচয় রোধের মহান শিক্ষাটি উপেক্ষিত। মসজিদ থেকে শুরু হোক অপচয় রোধের চর্চা। শিশু-কিশোরদের কোরআনসহ দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা দিতে মসজিদভিত্তিক মক্তবগুলোকে প্রাণ ফিরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। মসজিদকেন্দ্রিক বয়স্কদের জন্য মানসম্পন্ন কোরআন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। মুসলি্লদের ইসলামী জ্ঞানের চাহিদা মেটাতে একান্ত প্রয়োজনীয় গ্রন্থাবলিতে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার তৈরি করে মুসলি্লদের জ্ঞানপিপাসা মেটানো যায়। খতিবরা যেন মানসম্পন্ন খুতবা দিতে পারেন সেজন্য তাকে গবেষণা করার মতো বই-পুস্তক কিনে দেয়া উচিত। মসজিদের অর্থে আলোকসজ্জার মতো ইসলাম অননুমোদিত খাতে খরচ না করে মক্তব, পাঠাগারের মতো প্রয়োজনীয় খরচের খাতগুলোকে গতিশীল করলে একদিকে যেমন অপচয় রোধ করা যেত, অন্যদিকে মসজিদ ও সমাজের মৌলিক চাহিদাও পূরণ হতো।


শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়