Tuesday, December 29

সুদি ঋণের বিকল্প কর্জে হাসানা


মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: আর্থিক ইবাদতের মধ্যে একটি গুরুত্ববহ ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত হলো 'কর্জে হাসানা' তথা উত্তম ঋণ। পবিত্র কোরআনের ছয়টি আয়াতে মোট ১২টি স্থানে 'কর্জে হাসানা'র কথা উল্লেখিত হয়েছে। প্রত্যেক স্থানেই 'কর্জ'কে 'হাসান'-এর সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে। বোঝা গেল, কর্জে হাসানা একটি ইবাদত এবং মানবতার পুণ্যময় কল্যাণ। কোরআনে কারিমে ব্যবহূত এই কর্জে হাসানা (উত্তম ঋণ) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা, অভাবী, এতিম ও বিধবাদের ব্যয়ভার বহন করা, ঋণী ব্যক্তিদের ঋণ পরিশোধে সাহায্য করা এবং নিজ সন্তানাদি ও পরিবারের ওপর খরচ করা। মোটকথা মানব কল্যাণের যত দিক আছে সবগুলোই এর অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে কোনো পেরেশানগ্রস্তকে এই নিয়তে ঋণ দেয়া যে, ওই ব্যক্তি যদি স্বীয় পেরেশানির দরুন উক্ত ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তবে তার কাছে আর চাওয়া হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'এমন কে আছে যে আল্লাহকে করজ দেবে উত্তম করজ? অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাকে দ্বিগুণ ও বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আল্লাহই সংকোচিত করেন আবার তিনিই প্রশস্ততা দান করেন এবং তাঁরই কাছে তোমরা ফিরে যাবে।' (বাকারা : ২৪৫)। অন্যত্র এরশাদ করেন, 'তোমরা আল্লাহকে উত্তম পন্থায় ঋণ দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদের উদ্যানগুলোতে প্রবিষ্ট করব, যার তলদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত।' (মায়িদা : ১২)। আরও এরশাদ করেন, 'নিশ্চয়ই দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদের দেয়া হবে বহুগুণ এবং তাদের জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।' (হাদিদ : ১৮)। আল্লাহ তায়ালা অমুখাপেক্ষী হওয়া সত্ত্বেও কেন ঋণ চাইলেন? বান্দাদের করজে হাসানা প্রদানের প্রতি উদ্বুদ্ধ করার জন্য। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমস্যার শিকার ব্যক্তিকে ঋণ প্রদান করা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাকে ঋণ দেয়ার মতো। মহানবী (সা.) এর ভাষ্য অনুযায়ী, দানের চেয়ে ঋণ প্রদানের গুরুত্ব বেশি। দানের সওয়াব ১০ গুণ আর ঋণ প্রদানের সওয়ার ১৮ গুণ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, যখন কর্জে হাসানা সম্পর্কে কোরআন কারিমে আয়াত নাজিল হলো তখন হজরত আবু দারদা আনসারি (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবারে হাজির হয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তায়ালা কি আমাদের কাছে ঋণ চান? উত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, হ্যাঁ, তখন আনসারি সাহাবি বললেন, হুজুর! আপনার হস্ত মোবারক সামনে বাড়িয়ে দিন, আপনার হাতে হাত রেখে আমি একটি অঙ্গীকার করব। রাসুল (সা.) হাত বাড়িয়ে দিলেন। তখন হজরত আবুদ্দারদা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হাত ধরে অঙ্গীকার করেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার বাগান আল্লাহ তায়ালাকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলাম। ওই বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিল এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকত। তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দরবার থেকে উঠে নিজ বাগানে চলে গেলেন এবং স্বীয় স্ত্রীকে আওয়াজ দিয়ে বললেন, চল এই বাগান থেকে বের হয়ে এসো; এই বাগান আমি আমার রবকে করজ দিয়ে দিয়েছি। (তাফসিরে ইবনে কাসির)। আবু দারদা (রা.) এর দুইটি বাগান ছিল। তন্মধ্যে বাগানটিই ছিল তার নিকট খুব প্রিয়। যে বাগানে ৬০০ খেজুর গাছ ছিল এবং ওই বাগানে তার স্ত্রী-সন্তানও থাকত। এটিই তিনি স্বীয় রবকে করজ হিসেবে দিয়ে দিলেন। এসব ব্যক্তির প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'নিজেরা অভাবগ্রস্ত হলেও তারা নিজেদের ওপর অন্যদের প্রাধান্য দেয়।' (সূরা হাশর : ৯)। বিত্তশালীরা 'কর্জে হাসানা' নামক আর্থিক ইবাদতটি সম্পাদন করলে সমাজের অবহেলিত ও দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষগুলো নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ পায়। জাতীয় উৎপাদনে তারা তাদের কর্মশক্তি নিয়োগ করতে পারে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়েপড়া পরিবারগুলো শক্তি অর্জন করে অভাবের তাড়না থেকে মুক্তি পেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে যারা অসহায়ত্বের শিকার হয়ে সুদি ঋণ গ্রহণ করে তাদের সুদ নামক ভয়ানক অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। আমাদের দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে কর্জে হাসানা চালু থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কর্জে হাসানা প্রদানের সংস্কৃতি এখনও চালু হয়নি। বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ট্রাস্ট বিনা সুদে ছোট ও মাঝারি আকারের ঋণ প্রদান করে অসহায় পরিবারগুলোকে আত্মনির্ভরশীল করার পথ দেখাতে পারে। কর্জে হাসানা হতে পারে দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপকভিত্তিক শক্তিশালী মডেল এবং সুদি ঋণের উত্তম বিকল্প। তাছাড়া কর্জে হাসানা বা সুদমুক্ত ঋণ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র লোকদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। যারা অত্যন্ত অসহায়ত্বের শিকার তাদের কর্জে হাসানা প্রদান করে ছোটখাটো কোনো ব্যবসা ধরিয়ে দিয়ে দারিদ্র্যবিমোচনের ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনা যায়। যেমন- পোশাক তৈরি, এমব্রয়ডারি, কিচেন ব্যবস্থাপনা, খাদ্য তৈরি, মোটরসাইকেল মেকানিক, অটোমেকানিক, হাঁস-মুরগির খামার, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ওয়েল্ডিং, কাঠের সরঞ্জাম তৈরি, ছাগল পালন ইত্যাদি। তাছাড়া অসচ্ছল পরিবারের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাঋণ দিয়ে নিরক্ষরতা দূরীভূত করা যায়। কর্জে হাসানায় কোনো ধরনের সুদ, সার্ভিস চার্জ, লোন প্রসেসিং ফি, মুনাফা, জরিমানা থাকে না। নির্ধারিত মেয়াদের ভেতরে মূল টাকা ফেরত দিতে হয়। মোটকথা, সুদি ঋণপ্রথা বিমোচন করার জন্য কর্জে হাসানার ব্যাপক চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এতে একদিকে যেমন দরিদ্র মানুষ লাভবান হবে, অন্যদিকে সুদের বিষাক্ত ছোবল থেকে সমাজের মানুষকে রক্ষা করা যাবে। আর কর্জে হাসানায় দাতার জন্য তো অগণিত সওয়াবের ওয়াদা আছেই।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়