Monday, June 1

কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয়ের বিধান


মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব: কিস্তিতে লেনদেন মানে বিক্রেতা তার বিক্রীত পণ্য ক্রেতাকে বিক্রয় চুক্তির সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দেবে; কিন্তু ক্রেতা ততক্ষণাৎ ক্রয়মূল্য পরিশোধ করবে না। বরং ক্রেতা চুক্তিপত্রে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বিক্রয়মূল্য পর্যায়ক্রমে পরিশোধ করবে। এভাবে লেনদেন করাকে ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় ‘বাইয়ে বিত তাকসিত’ তথা কিস্তিতে ক্রয়-বিক্রয় বলা হয়। কিস্তিতে বেচাকেনা সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘বারিরা (রা.) এসে বলল, আমি নয় উকিয়ার বিনিময়ে নিজেকে গোলামি থেকে মুক্ত করার চুক্তি করেছি, প্রতি বছর এক উকিয়া করে দিতে হবে। সুতরাং আপনি আমাকে সাহায্য করুন।’ (বোখারি : ৩/১৫২)। কিস্তিতে বেচাকেনার বৈধতার বিষয়টি এ হাদিস দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যায়। কিস্তিতে বেচাকেনা মূলত বাকিতে বেচাকেনারই একটি পদ্ধতি। আল্লাহ তায়ালা বাকিতে লেনদেন সম্পর্কে এরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদাররা! যখন তোমরা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত বাকিতে লেনদেন করো, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও।’ (সূরা বাকারা : ২৮২)। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) এক ইহুদির কাছ থেকে বাকিতে কিছু খাবার খরিদ করেছিলেন এবং বিনিময়ে তার একটি লৌহবর্ম সেই ইহুদির কাছে বন্ধক রেখেছিলেন।’ (বোখারি : ১/২৭৭)। সুতরাং যেমনিভাবে বাকিতে ক্রয়-বিক্রয় জায়েজ, তেমনিভাবে কিস্তিতে বেচাকেনাও জায়েজ হওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের সমাজে কিস্তিতে বেচাকেনার বিভিন্ন পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে। সব পদ্ধতিকে নির্বিচারে জায়েজ বলা যায় না। তাই কিস্তিতে বেচাকেনা জায়েজ কিনা, এ বিষয়টি জানার আগে বেচাকেনা সম্পর্কে কিছু মৌলিক নীতি জানা প্রয়োজন। প্রথম মূলনীতি : ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সুদ হারাম। সুদ হলো বিনিময়হীন কোনো বস্তু বা মুনাফা লাভ করা। উল্লেখ্য, যে বস্তুকে শরিয়ত বিনিময়যোগ্য মনে করে না, তার বিনিময়ে কোনো কিছু লাভ করা, বিনিময় ছাড়া মুনাফা লাভেরই নামান্তর। আর তেমনই একটি বিষয় হলো ‘আজল’ বা মেয়াদ। শরিয়তের দৃষ্টিতে মেয়াদ বিনিময়যোগ্য কোনো বস্তু নয়। তাই বেচাকেনার ক্ষেত্রে মেয়াদের বিনিময়ে কোনো মুনাফা ধার্য করা হলে তা সুদ হিসেবেই বিবেচিত হবে। অতএব, ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার পর ক্রেতা যদি নির্দিষ্ট সময়ে মূল্য পরিশোধ না করে, তাহলে বর্ধিত সময়ের কারণে বিক্রেতা অতিরিক্ত মুনাফা দাবি করতে পারবে না। অনুরূপভাবে ক্রেতা যদি নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ঋণ পরিশোধ করে দেয়, তাহলে তার জন্য সময়ের আগে পরিশোধ করার কারণে কিছু টাকা কমিয়ে রাখার দাবি করাও জায়েজ হবে না। কারণ যদি এমনটি করা হয়, তবে তা ‘আজল’ তথা মেয়াদের বিনিময় ধরা হবে, যা নাজায়েজ ও হারাম। তবে যদি কেউ স্বেচ্ছায় কিছু বাড়িয়ে দেয় বা বিক্রেতা নিজ থেকেই কিছু কম নেয়, তবে তা ভিন্ন কথা। হজরত জাবের (রা.) বলেন, ‘নবী করিম (সা.) এর কাছে আমার কিছু ঋণ ছিল। আমি তার কাছে এলাম, তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। তিনি আমার ঋণ পরিশোধ করলেন এবং কিছু বাড়িয়ে দিলেন। (বোখারি : ১/৩২২)। দ্বিতীয় মূলনীতি : ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে (মাবি) বিক্রীত বস্তু ও (সামান) মূল্যের পরিমাণ এবং বাকিতে চুক্তি হলে তার মেয়াদ ইত্যাদি নির্ধারিত ও জানা থাকা শর্ত। এর কোনো একটি অনির্ধারিত বা অজানা থাকলে চুক্তি শুদ্ধ হবে না। ইমাম আবু বকর জাসসাস (রহ.) বলেন, ‘অজানা বস্তুর বিক্রি সহিহ হবে না। (শরহু মুখতাসারিত তাহাবি : ৩/১০৮)। তৃতীয় মূলনীতি : ইসলামী ফিকহের পরিভাষায় ‘সাফকা ফিস সাফকাহ’ তথা এক চুক্তির মাঝে আরেক চুক্তিকে শর্ত করা নিষিদ্ধ। এবার আমরা কিস্তির পদ্ধতিগুলো উল্লেখ করে উল্লিখিত নীতিমালার আলোকে শরয়ি সমাধান জানার চেষ্টা করব। কিস্তিতে যতগুলো পদ্ধতি আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে তার ভেতর কিছু বৈধ ও কিছু অবৈধ। বৈধ পদ্ধতি তিনটি প্রথম পদ্ধতি : পণ্যের মূল্য ১২ হাজার টাকা। মেয়াদ পাঁচ বছর, প্রতি মাসের কিস্তি ২০০ টাকা। এ পদ্ধতি উল্লিখিত নীতিমালার আলোকে বৈধ। তবে শর্ত হলো, কিস্তি আদায়ে বিলম্ব করলে এর বিনিময়ে কিছু নিতে পারবে না। অনুরূপ সময়ের আগে পরিশোধ করলে মূল্য কমানোর শর্তও করা যাবে না। তবে যদি ক্রেতা স্বেচ্ছায় কিছু বাড়িয়ে দেয়, অথবা বিক্রেতা নিজে থেকে কিছু কমিয়ে দেয়, তবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। দ্বিতীয় পদ্ধতি : পণ্যের মূল্য নগদে ১০ হাজার টাকা। বাকিতে ১২ হাজার টাকা। এ পদ্ধতি কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে জায়েজ হতে পারে। ক. যে কোনো একটি মূল্যকে মজলিসে থাকতেই নির্ধারণ করে নিতে হবে। অন্যথায় তা তৃতীয় মূলনীতির আলোকে বৈধ হবে না। ইমাম তিরমিজি (রহ.) আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবীজি এক চুক্তির মাঝে দুই চুক্তি করতে নিষেধ করেছেন।’ এরপর ইমাম তিরমিজি (রহ.) বলেন, কিছু ওলামায়ে কেরাম ওই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, যেমন কেউ বলল, ‘আমি তোমার কাছে এ কাপড়টি নগদে ১০ টাকায় আর বাকিতে ২০ টাকায় বিক্রি করলাম। আর ক্রেতা কোনো একটি মূল্য নির্ধারণ করা ছাড়াই তার থেকে পৃথক হয়ে যায় (তাহলে জায়েজ হবে না)। তবে যদি সে যে কোনো একটি মূল্য নির্ধারণ করে পৃথক হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই।’ (সুনানে তিরমিজি : ১/২৩৩)। ইমাম জাসসাস (রহ.) বলেন, ‘দুই চুক্তিকে এক চুক্তির মাঝে অন্তর্ভুক্ত করা, এটা এ পদ্ধতিকেও অন্তর্ভুক্ত করে, কেউ এভাবে বিক্রি করল যে, নগদে এত আর বাকিতে এত।’ (শরহু মুখতাসারিত তহাবি : ৩/৯৯)। ইমাম সারাখসি (রহ.) বলেন, ‘যদি কেউ এভাবে চুক্তি করে যে, অমুক মেয়াদ পর্যন্ত এত টাকায়, আর নগদে এত টাকায়। অথবা বলল, এক মাসের মেয়াদে এত টাকায় আর দুই মাসের মেয়াদে এত টাকায়, তাহলে ওই চুক্তি শুদ্ধ হবে না। কারণ সে কোনো নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে লেনদেন করেনি। অথচ নবী করিম (সা.) এক চুক্তির মাঝে দুইটি শর্ত করতে নিষেধ করেছেন। ওই সুরতটি এ হাদিসের ব্যাখ্যা। আর এটা তখনই হবে, যখন তারা (ক্রেতা-বিক্রেতা) উভয়ে কোনো একটি মূল্য নির্ধারণ না করেই পৃথক হয়ে যাবে। হ্যাঁ, যদি তারা উভয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে একটি মূল্য নির্ধারণ করে চুক্তি নিশ্চিত করে পৃথক হয়, তবে তা জায়েজ হবে। কারণ তখন তারা চুক্তি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্ত পূর্ণ করেই পৃথক হয়েছে।’ (আল-মাবসুত ১৩/৮)। খ. বাকির মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় দ্বিতীয় মূলনীতি অনুযায়ী তা অবৈধ হবে। গ. বাকিতে বিক্রির কারণে মূল্য বাড়ানো হলে তা পণ্যের মূল্য হিসেবেই উল্লেখ করতে হবে। মেয়াদের বিনিময় হিসেবে নয়, অন্যথায় প্রথম মূলনীতি অনুসারে তা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। সুতরাং মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও বিলম্ব হলে তার ওপর অতিরিক্ত কিছু দাবি করা যাবে না। অনুরূপ মেয়াদের আগে পরিশোধ করলেও নির্ধারিত মূল্য থেকে কমানোর শর্ত করা যাবে না। তৃতীয় পদ্ধতি : নগদ মূল্য পাঁচ হাজার টাকা, দুই বছর মেয়াদে সাত হাজার টাকা এবং পাঁচ বছর মেয়াদে ১০ হাজার টাকা। এ পদ্ধতিতে শুধু নগদ আর বাকির ওপরই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং বাকির মধ্যে আবার মেয়াদের কমবেশির কারণে মূল্যের মধ্যে কমবেশি করা হয়েছে। এ পদ্ধতিটি দ্বিতীয় সুরতে উল্লিখিত ‘ক’ ও ‘গ’ শর্ত সাপেক্ষ জায়েজ হবে। ওই পদ্ধতিটির প্রতি ইমাম সারাখসি (রহ.) এর লেখায় ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যা এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। অবৈধ পদ্ধতি চারটি প্রথম পদ্ধতি : বিক্রেতা এভাবে মূল্য উল্লেখ করল, পণ্যের মূল্য ১২ হাজার টাকা। বাকির মেয়াদ এক বছর। প্রতি মাসে আদায় করতে হবে এক হাজার টাকা হারে, সঙ্গে অতিরিক্ত দিতে হবে প্রতি মাসে ১০০ টাকা হারে। এ পদ্ধতিটি প্রথম মূলনীতি অনুযায়ী নাজায়েজ ও হারাম। কারণ এতে মেয়াদের বিপরীতে মুনাফা ধার্য করা হয়েছে। মেয়াদ শরিয়তের দৃষ্টিতে বিনিময়যোগ্য বস্তু নয়। সুতরাং এর বিনিময়ে মূল্য সাব্যস্ত করা স্পষ্ট সুদ। দ্বিতীয় পদ্ধতি : বিক্রেতা এভাবে বলল, পণ্যের মূল্য ১২ হাজার টাকা। বাকির মেয়াদ দুই বছর। প্রতি মাসে দিতে হবে ৫০০ টাকা। তবে প্রতি মাসে মূলধনের পাঁচ শতাংশ অতিরিক্ত দিতে হবে। এ পদ্ধতিটিও প্রথম পদ্ধতির মতোই একই কারণে নাজায়েজ ও হারাম। তৃতীয় পদ্ধতি : এভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হলো যে, পণ্যের মূল্য ১২ হাজার টাকা। টাকা যত মাস বিলম্ব করে পরিশোধ করা হবে, প্রতি মাসেই মূলধনের অতিরিক্ত ১০০ টাকা মূলধনের সঙ্গে যোগ করা হবে। এভাবে যত মাস যাবে, তত মাস হিসাবে অতিরিক্ত টাকা যুক্ত হতে থাকবে। এ পদ্ধতিটি কয়েক কারণে নাজায়েজ। ক. দ্বিতীয় মূলনীতি অনুসারে বাকিতে লেনদেনের ক্ষেত্রে মেয়াদ নির্ধারণ করতে হবে, অন্যথায় তা শুদ্ধ হবে না। এখানে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়নি, তাই তা শুদ্ধ হবে না। খ. এখানে মেয়াদের মোকাবিলায় মুনাফা ধার্য করা হয়েছে, যা প্রথম মূলনীতি অনুযায়ী সুদ ও হারাম। চতুর্থ পদ্ধতি : পণ্যের মূল্য ৫০০ টাকা। এক মাস পর দিলে অতিরিক্ত (মুনাফা) দিতে হবে মূলধনের পাঁচ শতাংশ। দুই মাস পর দিলে অতিরিক্ত দিতে হবে মূলধন ও মুনাফার পাঁচ শতাংশ। এভাবে প্রতি মাসে মূলধন ও মুনাফার পাঁচ শতাংশ করে চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকবে। এ পদ্ধতিটিও নাজায়েজ ও হারাম। কারণ এখানে প্রথম পদ্ধতির সমস্যাগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আরও মারাত্মক একটি সমস্যা যুক্ত হলো, আর তা হলো, এখানে সুদের ওপর সুদ আসে। কারণ প্রথম মাসে সুদ আসবে মূলধনের ওপর ২৫ টাকা। পরের মাসে মূলধনের সঙ্গে সঙ্গে সুদ ২৫ টাকার ওপরও সুদ আসবে, এভাবে সুদের পরিমাণ দিন দিন বাড়তে থাকবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়