মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ:
যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, পেরেশানি ও অশান্তির জায়গা হলো দুনিয়া। পৃথিবীর এ অশান্তি ও দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় মালিকের সন্তুষ্টি। যার হাতে ধন-সম্পদ, ইজ্জত-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও দুনিয়ার যাবতীয় সুখ-শান্তির ভান্ডার। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরগুলো শান্তি পায়। যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ এবং মনোরম প্রত্যাবর্তন স্থল।’ (সূরা রাদ : ২৮-২৯)।
রোগব্যাধি বা শারীরিক কোনো অসুস্থতা, নিজের আর্থিক বা দৈহিক কোনো দুশ্চিন্তা, শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার ভয় কিংবা ভূকম্পন বা দুর্ঘটনাজনিত যে কোনো বিপদাপদ থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে প্রতিপালকের সন্তুষ্টি। এরশাদ হচ্ছে, ‘যে সৎকাজ সম্পাদন করে সে ঈমানদার পুরুষ হোক কিংবা নারী, আমি তাকে পবিত্র (শান্তিময়) জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরস্কার দেব, যা তারা করত।’ (সূরা নাহল : ৯৭)।
মানুষ যদি ঈমান ও আমলে সালেহ (সৎকাজ) করে, তাহলে আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি হলো- তিনি অবশ্যই শান্তির জীবন দান করবেন। এটি বান্দার জন্য আল্লাহ তায়ালার কৃত ওয়াদা; যা তিনি তিনটি দৃঢ়তাসূচক শব্দ দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা শপথ করে বলেছেন, ‘যে আমার সন্তুষ্টি অর্জন করবে, অবশ্যই আমি তাকে সব অশান্তি থেকে মুক্তি দেব এবং শান্তির জীবন দান করব।’ অন্যথায় বলেন, ‘আর যে আমার এ উপদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, তার জীবিকা সঙ্কীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কেয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় তুলব। সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় তুললে? আমি তো দৃষ্টিসম্পন্ন ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, ‘যেমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াতগুলো এসেছিল, আর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে; তেমনিভাবে আজ তোমাকে ভুলে যাব। যে সীমা লঙ্ঘন করে এবং পালনকর্তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে না, আমি তাকে এমনই প্রতিফল দেব। আরপরকালের শাস্তি কঠোরতর এবং অনেক স্থায়ী।’ (সূরা ত্বহা : ১২৪-১২৭)।
‘আমলে সালেহ’ তথা সৎকাজের অর্থ
‘আমলে সালেহ’ নিয়ে মানুষ আজ ব্যাপকভাবে ভুল ধারণায় লিপ্ত। অনেকেই মনে করে, খুব বেশি নফল নামাজ ও জিকির-আজকার করাই হলো ‘আমলে সালেহ’। বস্তুত ‘আমলে সালেহ’ এর অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালার নাফরমানি বর্জন করা।
মানুষ তার যাবতীয় অশান্তি থেকে তখনই মুক্তি পাবে, যখন সে তার মালিকের সব নাফরমানি থেকে তওবা করে তাঁর সন্তুষ্টি হাসিল করবে। কারণ মালিক তো শুধু নফল নামাজ, নফল রোজা, নফল দান-খয়রাত আর জিকির-আজকারে সন্তুষ্ট হন না। বরং তাঁর সব নাফরমানি থেকে ফিরে আসার কারণেই সন্তুষ্ট হন। তাই তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টিকুলের যাবতীয় অধিকার আদায় করে এবং তাঁর ফরজগুলো পালনের পাশাপাশি যাবতীয় গোনাহ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পূতপবিত্র রাখা চাই। যদি কেউ নফল ইবাদত এবং তাসবিহ-তাহলিলের ক্ষেত্রে খুব যত্নবান হয়; কিন্তু ফরজ-ওয়াজিবের ব্যাপারে একেবারে উদাসীন হয় অথবা প্রতি বছর সে হজ করে, গরিব-মিসকিনকে দান করে, মাদরাসা-মসজিদ নির্মাণ বা তার সার্বিক উন্নয়নে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে; কিন্তু সুদ খায়, ঘুষ লেনদেন করে, মাপে কম দেয় কিংবা ভেজাল করে অথবা অন্য যে কোনোভাবে সে বান্দার অধিকার নষ্ট করে, আর মনে মনে ধারণা করতে থাকে- আমি তো ঈমানের পাশাপাশি ‘আমলে সালেহ’ এর দায়িত্বও পুরোপুরি আদায় করছি। তাছাড়া আমি তো মোত্তাকি-পরহেজগার। তাহলে তার সবই বেকার যাবে। আসলে এ ধরনের লোক চরমভাবে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত। তাদের ব্যাপারেই পবিত্র কোরআনে এরশাদ হচ্ছে, ‘তারাই সেসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। অথচ (অজ্ঞতার কারণে) মনে করে, তারা সৎকর্ম করছে।’ (সূরা কাহাফ : ১০৪)।
জীবনকে ইবাদত-বন্দেগির রঙে রঙিন করার আগে গোনাহ থেকে নিজেকে পূতপবিত্র করার প্রতি সুফি-সাধকরা বেশ গুরুত্বারোপ করেছেন। বস্তুত গোনাহ বর্জন এবং যথাযথভাবে ফরজ আদায় করার নামই ‘আমলে সালেহ’। এর ওপর যে বেশি যত্নবান হবে, আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে তার এমনই এক আত্মিক সম্পর্ক সৃষ্টি হবে, যার ফলে তাঁর পক্ষ থেকেই নফল ইবাদত এবং জিকির-আজকারের তৌফিক এমনিতেই হাসিল হবে। তখন বান্দার অন্তরে আল্লাহপ্রেম এমনভাবে প্রোথিত হবে যে, পরম প্রিয় প্রেমিক আল্লাহ তায়ালার জিকির ছাড়া সে থাকতেই পারবে না। তাঁর কাছে নিজের কৃত সব গোনাহের জন্য তওবা করার পর তার অবস্থা এমনই হবে, যেমন হয়েছিল হজরত মাজজুব (রহ.) এর। তিনি সর্বদাই কেঁদে কেঁদে বলতেন, ‘হে মাওলা, দুনিয়ার সব আশা-আকাক্সক্ষা থেকে আমার অন্তর আজ শূন্য। শূন্য এ হৃদয়ে আসীন হয়ে তুমি আজ আমায় ধন্য কর।’
মানুষ যখন যথাযথভাবে ফারায়েজ আদায় করে এবং যাবতীয় গোনাহের কাজ পরিহার করে, তখন নফল ইবাদতের স্পৃহা তার অন্তরে এমনিতেই জাগ্রত হয়। এটি একটি অনিবার্য বিষয়। কিন্তু শয়তান এবং মানুষের কু-প্রবৃত্তি মানুষকে সবসময় এ প্রবঞ্চনা দিতে থাকে- ‘নফল ইবাদতে মশগুল থাক, গোনাহ ছাড়ার দরকার নেই।’ বর্তমানে নামধারী অনেক পীর-মাশায়েখ এবং ওয়ায়েজিনে কেরাম তাদের ভক্তদের এ সবক দেন যে, ‘অমুক তাসবিহ এবং এত এতবার নফল পড়, আমলে সালেহ হয়ে যাবে। তার মানে দাঁড়ায় হারাম ছাড়ার প্রয়োজন নেই। গোনাহ থেকে বাঁচার দরকার নেই। নফল বিষয়ের অনুসরণ করতে থাক। আল্লাহ খুশি, বান্দাও খুশি। পীর খুশি, ভক্তও খুশি। দ্বীনও বাকি রইল, দুনিয়াও হাতছাড়া হলো না।’ এ অজ্ঞতায় যারা নিজেকে নেককার এবং ‘আমলে সালেহ’ এর অনুসৃত মনে করছে, তারা হাজারো রেওয়াজ, বেদাত ও কুসংস্কারের মধ্যে ডুবে আছে। বড় আফসোস, উম্মতের এ করুণ অবস্থায় সঠিক পথ দেখানোর অনেকেই আছেন। কিন্তু আমাদের যাতায়াত নেই সেসব দরবারে। তাই বিপদাপদ থেকে মুক্তি লাভের আশায় এবং পৃথিবীর সুখ-শান্তির জন্য চাই আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর ‘আমলে সালেহ’ এর মাধ্যমেই শুধু তা সম্ভব। সে পথের দিশা পেতে আত্মশুদ্ধি ও সহিহ তরিকার পীর-মুরশিদের দরবারে গমনাগমনের বিকল্প নেই।

0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়