Sunday, November 23

বিশ্বাসীর অনন্ত আবাস


মাওলানা বায়েজীদ হোসাইন সালেহ :মাহমুদ গাওয়ান মাদরাসা। বিদর, কর্নাটকে অবস্থিত মধ্যযুগে ভারতের আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। পারসিক বণিক প-িত খাজা মাহমুদ গাওয়ান ছিলেন বাহমনী সুলতান তৃতীয় মোহাম্মদ শাহ্ (১৪৬৩-৮২) এর উজির। ১৪৭২ সালে তার নির্মিত মাদরাসাটি তৎকালীন সময়ের শ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল। ১৬৯৬ সালে মাদরাসা ভবনটির অধিকাংশ ধ্বংস হয়ে যায় জান্নাত শব্দটি আরবি। অর্থ উদ্যান, বাগান, সুখময় স্থান ইত্যাদি। ফার্সিতে বলা হয় বেহেশত। এটি ইহকালীন ক্ষণস্থায়ী জীবন অবসানের পর মোমিন মুসলমান তথা সৎ লোকদের জন্য অনাদি অনন্ত সুখময় চিরস্থায়ী জীবনের সুসজ্জিত নিবাস। কোরআনে জান্নাত : এরশাদ হয়েছে, আল্লাহ মোমিন নারী-পুরুষকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের। যার তলদেশে ঝরনাধারা প্রবাহিত, সেথায় তারা চিরকাল থাকবে। এ চির সবুজ-শ্যামল জান্নাতে তাদের জন্য রয়েছে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন বসবাসের স্থান। (সূরা তওবা-৭২)। 'তোমরা তোমাদের প্রভুর ক্ষমা লাভের প্রতি দ্রুত ধাবিত হও এবং সে জান্নাতের প্রতি, যার আয়তন আসমান ও জমিনের সমান।' (সূরা আলে ইমরান : ১৩৩)। 'মোত্তাকি লোকদের জন্য ওয়াদাকৃত জান্নাতের দৃষ্টান্ত হলো, তাতে রয়েছে স্বচ্ছ পানির ঝরনাগুলো, চির সুস্বাধু দুধের প্রবাহ, পানকারীদের জন্য বিশেষ স্বাদযুক্ত পানীয়ের প্রবাহ, বিশুদ্ধ নহর ও ঝরনাধারা প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন মধুর।' (সূরা মুহাম্মদ : ১৫)। হাদিসে জান্নাত : হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমি নেককার বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমনসব নেয়ামত তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চোখ দেখেনি, কোনো কান শোনেনি এবং কোনো অন্তরও তার সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। (বোখারি ও মুসলিম)। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, অবশ্যই জান্নাতিরা জান্নাতে খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করবে; কিন্তু তাদের থুথু ফেলা, পেশাব-পায়খানা করার অথবা নাক ঝাড়ার প্রয়োজন হবে না। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), তাদের ভক্ষ্যবস্তুর (পেটে) কী দশা হবে? প্রিয় নবী (সা.) বললেন, ঢেঁকুরের মাধ্যমে বের হবে; কিন্তু তা থেকে মেশকের সুগন্ধ বের হবে। আর জান্নাতবাসীর অন্তরে আল্লাহর তাসবিহ ও তাহমিদ এমনভাবে বেঁধে দেয়া হবে যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস বের হয়। (মুসলিম)। জান্নাতের অবস্থান : হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম (রা.) বলেন, আমি সৃৃষ্টির সেরা নবী থেকে শুনেছি যে, তিনি এরশাদ করেন, জান্নাত আসমানে অবস্থিত। হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, আমি প্রিয় নবী (সা.) কে বলতে শুনেছি, জান্নাতের ১০০টি স্তর রয়েছে। প্রত্যেক দুই স্তরের মধ্যখানে আসমান ও জমিনের মধ্যকার সমান দূরত্ব রয়েছে। এসব স্তরের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ স্তর হলো জান্নাতুল ফেরদাউস। তার ওপরই আরশের অবস্থান। জান্নাতের সংখ্যা : জান্নাত মোট আটটি। ১. জান্নাতুল ফেরদাউস ২. দারুল মাকাম ৩. জান্নাতুল মাওয়া ৪. দারুল কারার ৫. দারুস সালাম ৬. জান্নাতুল আদন ৭. দারুন নাঈম ৮. দারুল খুলদ। জান্নাতের দরজা : হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে, ১. নামাজিদের দরজা ২. রোজাদারদের দরজা ৩. সত্যবাদীদের দরজা ৪. পরস্পর বন্ধুত্ব স্থাপনকারীদের দরজা ৫. বিনয়াবনত লোকদের দরজা ৬. জিকিরকারীদের দরজা ৭. ধৈর্যশীলদের দরজা ৮. ভরসাকারীদের দরজা। এছাড়া হাকিম তিরমিজি (রহ.) নাওয়াদিরুল উসুল নামক গ্রন্থে আরও তিনটি দরজাকে বৃদ্ধি করেছেন। ১. বাবুল হজ ২. বাবুস সিলাহ ৩. বাবুল ওমরা। আর আল্লামা ইমাম কুরতুবী (রহ.) সর্বমোট ১৮টি দরজা গণনা করেছেন। (তাজকিরাতুল কুরতুবী)। জান্নাতের চিত্র : হজরত ওসামা বিন জায়েদ (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, কেউ কি আছো জান্নাতের জন্য প্রস্তুত? কারণ, এ জান্নাত হবে এমন যা কখনও ফানা (ধ্বংস) হবে না। কাবার রবের শপথ, তা এমন একটি নূর যা সর্বদা দুলতে থাকে। এমন একটি ফুলের তোড়া যা হৃদয়কে আকর্ষণ করতে থাকে। এমন একটি বালাখানা যা খুবই উঁচু, তাতে এমন নদী রয়েছে যা সর্বদা প্রবাহিত হতে থাকে। এমন ফল রয়েছে যা পেকে আছে (সদ্য খাওয়ার যোগ্য)। সেখানে এমন স্ত্রী রয়েছে যা অপূর্ব সুন্দরী। প্রশান্তিময় বাসভবন রয়েছে, যা চিরকাল থাকবে। থোকা থোকা ফল, চতুর্দিকে সবুজ অরণ্য। উঁচু উঁচু নজর কাড়া বালাখানা। (ইবনে মাজা)। হজরত আবু সাঈদ খুদারি (রা.) থেকে বর্ণর্িত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহ জান্নাতিদের ভবনের প্রাচীরগুলো নির্মাণ করেছেন, একটি ইট স্বর্ণের, আরেকটি রৌপ্যের। ফেরেশতারা যখন জান্নাতের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করবে, তখন বলতে থাকবে, হে জান্নাত, বাদশাহদের ভবন হিসেবে তোমাকে মোবারকবাদ। (তাবরানি)। জান্নাতের ভূমি হবে ধবধবে সাদা রুপার, যা আয়নার মতো স্বচ্ছ। জান্নাতের ছায়ার দৈর্ঘ্য হবে ৭০ হাজার বছরের দূরত্ব। (বায়হাকি)। জান্নাতের আবহাওয়া হবে নাতিশীতোষ্ণ। (সিফাতুল জান্নাহ)। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, তোমরা সাদা রঙ গ্রহণ কর। কারণ আল্লাহ তায়ালা জান্নাতকে সাদা বানিয়েছেন। সুতরাং তোমাদের জীবিতরা যেন সাদা কাপড় পরিধান করে এবং মুরদারদের তোমরা সাদা কাপড়ের কাফন পরিধান করাও। হজরত ওসমান বিন জায়েদ (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, জান্নাত হলো ফুলের একটি তোড়া, যা মানুষকে উন্মাদ করে দেয় এবং যার আলো অত্যন্ত ঝলমলে। (সিফাতুল জান্নাহ)। জান্নাতের ঘ্রাণ ৭০ বছরের দূরত্ব থেকেও উপলব্ধি করা যাবে। (বোখারি)। প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেছেন, জান্নাতে ১০০টি স্তর রয়েছে। প্রত্যেক দুই স্তরের মাঝে ব্যবধান হলো আসমান ও জমিনের দূরত্বের সমান। প্রথম স্তরের ঘরবাড়ি, কক্ষ, দরজা, খাট ও তালা হবে রুপার তৈরি। দ্বিতীয় স্তরের ঘর-বাড়ি হবে স্বর্ণের তৈরি। তৃতীয় স্তরের ঘরবাড়ি, কক্ষ, দরজা, খাট ও তালা হবে মোতি, ইয়াকুত ও জবরজদের তৈরি। এছাড়া বাকিগুলো কীসের তৈরি হবে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। (আল বুদুরুস সাফেরা)। জান্নাতের চাবি : হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, প্রিয় নবী (সা.) এরশাদ করেন, নামাজের চাবি হলো অজু আর জান্নাতের চাবি হলো নামাজ। (তিরমিজি)। জান্নাতের মূল্য : হজরত আনাস (রা.) বলেন, জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি একদা প্রিয় নবী (সা.) এর খেদমতে এসে হাজির হলো। সে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), জান্নাতের মূল্য কী? তিনি উত্তরে বললেন, কালেমায়ে তাইয়্যেবাহ পাঠ করো। জান্নাতি হওয়ার জন্য করণীয় : আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, যারা ঈমান এনেছে এবং নেক কাজ করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাতুল ফেরদাউস। সর্বদা সৎ কাজ করা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা। এ ছাড়া মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, মোনাফেকি, হারাম বর্জন করা, সত্য বলা, পরোপকার করা। এক কথায় জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত কোরআন-সুন্নাহ মোতাবেক জীবন গড়ার মাধ্যমে একজন খাঁটি মুসলমান হতে পারলেই জান্নাতের বাসিন্দা হয়ে আল্লাহর দিদার লাভ করা সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়