Monday, November 3

সত্যের জন্য জীবন উৎসর্গের শিক্ষা


শাহসুফি সৈয়্যেদ নূরে আখতার হোসাইন কারবালার ইতিহাস বিশ্ব মানবতার জন্য শিক্ষার ইতিহাস। অত্যাচারী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে ঈমানি শক্তিতে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে যাওয়ার ইতিহাস। সৎকাজের প্রতি মানুষকে আহ্বান করা আর অসৎ কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার ইতিহাস। ইসলামের ইতিহাসে অসংখ্য ঘটনার মাঝে কারবালার ঘটনাটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। ইমাম হোসাইন (রা.) এর বীরত্বপূর্ণ যে সাহসী ভূমিকা ছিল কারবালার ঘটনায় তা হক ও বাতিলের মধ্যে সংঘর্ষ হিসেবে ইতিহাসে ভাস্বর হয়ে আছে। হোসাইন (রা.) এর সামনে মাত্র দুটি পথ খোলা ছিল। হয় ইসলাম বা দ্বীনকে রক্ষা করা অথবা নিজের জীবন রক্ষা করা। কেননা কোনোরকম সংলাপ কিংবা কৌশলে দ্বীনের সংস্কার করা তখন সম্ভব ছিল না। তিনি তাই নিজের নশ্বর জীবনের ওপর দ্বীনকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তিনি জুলুম-অত্যাচার দমনের জন্য পা বাড়ালেন। রাসূলে পাক (সা.) এর হাদিসের উদ্ধৃতি তুলে তিনি বলেছিলেন, তোমাদের মধ্য থেকে যে-ই অত্যাচারী কোনো শাসককে দেখতে পাবে_ যে খোদার বিধানের বিরোধিতা করে, আল্লাহর বান্দাদের মাঝে অন্যায় এবং শত্রুতামূলক আচরণ করে, সে যদি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করে কিংবা তাকে তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তা থেকে না ফেরায় তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে সেই স্থানে প্রবেশ করাবেন যেখানে প্রবেশ করবে ওই অত্যাচারী। ইমামের এ বক্তব্য শুনে পর্বতপ্রমাণ আস্থা ও ভালোবাসায় যারা সেদিন ইমামের সঙ্গত্যাগী না হয়ে শাহাদাতের পথ বেছে নিয়েছিলেন তারাই আজ ইতিহাসে জীবিত আছেন। ইমামের প্রতি আনুগত্যের সেই নিদর্শন ইতিহাসে বিরল। আসলে ইমাম হোসাইন (রা.) এর সঙ্গীরা যে জেনে-বুঝেই তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন তা খুবই স্পষ্ট। ইমামকে ভালোবেসে, তার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রেখেই তারা ইমামের সঙ্গে থেকে প্রাণপণে সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীদের ওপর যে আঘাত হানা হয়েছে, তরবারির সেই আঘাতের যন্ত্রণার চেয়ে আরও বেশি কষ্টকর ছিল জনগণের মূর্খতা ও অজ্ঞতার আঘাত। সেজন্যই জনতার চিন্তার ভুবন থেকে অজ্ঞতার পর্দা অপসারণ করাই ছিল তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ। এ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই ইমাম এবং তার সঙ্গীরা দ্বীনের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হন। ইমামের পদাঙ্ক এমনভাবে তারা অনুসরণ করেছেন যে, পৃথিবীর কোনো স্বার্থই তাদের ইমামের আনুগত্য থেকে দূরে সরাতে পারেনি। আশুরার রাতে ইমাম তার সঙ্গীদের বলেছিলেন, তোমরা যদি প্রাণে বেঁচে থাকতে চাও তাহলে যুদ্ধের ময়দানে যাওয়া থেকে আত্মরক্ষা কর। কিন্তু ইমামের একনিষ্ঠ অনুসারীরা একবাক্যে ইমামের সঙ্গে আমৃত্যু থাকার অঙ্গীকার করে বলেন, আমরা যদি শত শত বার মারা গিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাই কিংবা আমাদের দেহগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়, তারপরও যদি জীবিত হই, আপনার সঙ্গেই থাকব। কেননা আপনি রাসূলে খোদার দৌহিত্র, আপনি মুসলমানদের নেতা এবং পথপ্রদর্শক। মৃত্যু পর্যন্ত আমরা আপনার সঙ্গে সর্বদা আছি। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৭২ জন, পক্ষান্তরে ক্ষমতাসীন ইয়াজিদের সৈন্যসংখ্যা ২২ হাজার। ইমামের সঙ্গীদের সবাই জানতেন কয়েক ঘণ্টা পরই তারা শহীদ হবেন। তারপরও যুদ্ধের ময়দানে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একজন আরেকজনকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। উদ্দেশ্য একটাই ঈমানি দায়িত্ব পালন করা। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ইসলাম নামের বৃক্ষের মূলে ঢেলে দিয়ে বৃক্ষটিকে চিরসজীব রাখা। ঈমানি শক্তিতে পূর্ণ, বীরত্বের শক্তিতে অতুলনীয় এমন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বদের উদাহরণ ইতিহাসে বিরল। জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইন (রা.) এর সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় কারবালার ঘটনা একটি মাইলফলক। এ দিনে ইমামের শাহাদাতের মধ্য দিয়ে ঐতিহাসিক এ ঘটনার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটেছিল বলে মনে হলেও মূলত সেখান থেকেই এ ইতিহাস হয়ে আছে অমর, চিরন্তন। বিশ্বব্যাপী আজ ইমাম হোসাইন (রা.) এর সেই সংগ্রাম প্রতিটি স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের নেপথ্য প্রেরণা, সব সত্যানুসন্ধানীর পথের দিশা, মুসলিম চেতনা জাগরণে অতুলনীয় অনুপ্রেরণা। তাই তো কবির মুখের বাণী, 'ইসলাম জিন্দা হোতা হায়, হর কারবালা কী বাদ।' লেখক : প্রাবন্ধিক ও ইসলামি চিন্তাবিদ

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়