রাজধানীর বাড্ডায় নির্মমভাবে নিহত হন রেনু বেগম। শনিবার (২০ জুলাই)
সকালে ঢাকার উত্তর পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাসলিমা
বেগম রেনুকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মেয়েকে ভর্তির জন্য ওই স্কুলে
খোঁজ নিতে গিয়ে কথাবার্তায় সন্দেহ হলে মুহুর্তের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়ে
ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনি দিলে তার মৃত্যু হয়।
রেনুর বড় ভাই রিয়াজ মাহমুদ বোন রেনুকে নিয়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। রিয়াজ মাহমুদের স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল:-
নিহত
রেনুর ছেলে তাসফিক আল মাহি (১১) বাবার সঙ্গে থাকে। মেয়ে তাসলিমা তুবা (৪)
থাকতো মায়ের কাছে। মা শিশু তুবাকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন, কিন্তু অবুঝ শিশু
জানেনা মা কোথায়।
আমার বোন আমার চেয়ে বয়সে দশ বছরের ছোট হবে। রেনু
ওর নাম। গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে ওর। ছোট বেলা হতে কিছুটা নার্ভাস প্রকৃতির
রেনু ছিল খুব মেধাবী। স্কুলে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সব সময় ফার্স্ট গার্ল।
বাবা
রেনুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন সে ডাক্তার হবে নয়তো সরকারি বিসিএস
কর্মকর্তা। কিন্তু সংসার জীবনটা রেনুর সুখের হয়নি। ছোট ছোট দুটি সন্তান
নিয়ে সে একাই জীবন অতিবাহিত করছিল।
সংসার ভেঙে গেছে বেশ আগেই। বাবা ও
মা মারা গিয়েছেন। রেনু নিজের মতো করেই সন্তানদের ভাল স্টুডেন্ট হিসেবে গড়ে
তুলতে চেয়েছিল। ছোট বাচ্চাটার মাত্র চার বছর বয়স। মৃত্যুর আগের রাতে
কিছুটা অস্থির দেখাচ্ছিল রেনুকে।
ছোট বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার জন
সকালে স্কুলে যাবে। সকাল হলে বাসার কাছে প্রাইমারি স্কুলটায় ভর্তির বিষয়ে
খোঁজখবর নিতে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই অপরিচিত দুটি বখাটে ছেলে তাকে
অহেতুক প্রশ্ন করতে শুরু করলে সে নার্ভাস হয়ে যায়।
রেনুর বেশ মানসিক
অস্বস্তি হয় এধরনের জেরায়। সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। তার মতো সাধারণ
মেয়ে সারাজীবনে চাকরি সংসার সমাজ ইত্যাকার বহির্মুখী অনুষঙ্গকে আত্মস্থ
করতে পারেনি তার অন্তর্মুখী স্বভাবের জন্য।
যেমন পুলিশ, মাস্তান,
ক্ষমতাবান, ডোমিনেটিং সোসাইটি, প্রভাব বিস্তারকারী মানুষজনের সামনে পড়লে সে
ভাষা হারিয়ে ফেলতো। কিন্তু মনে মনে সে ভাবতো অন্যরা তো বেশ মানিয়ে নিয়ে
চলছে ফিরছে, সে পারছে না কেন?
কেন এসব পরিস্থিতিতে পড়লে তার কথা বলার
স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলে সে। কেন সে পরিষ্কার করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে
পারে না, কেন সে মানুষের প্রশ্নের (অযাচিত) পরিষ্কার জবাব দিতে পারে না।
কেন
সে ছোট বেলায় দোষ না করেও মায়ের কড়া ধমকে চুপ করে ছিল, কেন সে স্বামীর
অন্যায়েও নিঃশব্দ ছিল, কেন সে পুলিশের নাম শুনলেই অপরাধীর মতো ভয়ে নিজের
মধ্যে সেঁধিয়ে পড়তো সে নিজেও জানে না।
সে ভয় পেতো চেনা পরিচিত ঢাকা
শহরের এসব কিছু এই ছিল সত্য। সেই সত্যটাই তার জীবন নিয়েছে। সেই প্রখর
খরতাপের মধ্যে শত শত মানুষের কয়েকজন তাকে নৃশংসভাবে পেটালো। পিটিয়ে তার
সারা শরীর থেঁতলে দিল।
শেষ নি:শ্বাস বের হবার আগে তখনও সে তাকিয়েছিল
মানুষগুলোর দিকে। রক্তমাখা মুখ, কপালের মধ্যে রক্তভেজা চুলগুলো ঘামে,
রক্তে লেপটে আছে, সেই অবস্থায় তাকিয়েছিল মানুষের (মানুষ?) দিকে।
হয়তো
শেষ মুহূর্তেও চেষ্টা করছিল গুছিয়ে কিছু বলতে…। ভাইগো ও ভাই, আমি এখানে
এসেছিলাম আমার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে…, আমি ছেলে ধরা না। আমার নাম
তাসলিমা রেনু। দুটো বাচ্চা আছে আমার। আমি মরে গেলে ওদের কেউ থাকবে না। এখনো
যদি আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান আমি মরবো না। আমি সুস্থ হয়ে তাড়াতাড়ি বাসায়
ফিরতে চাই। বাসায় বাচ্চাগুলো আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।”
কিন্তু
বোবার মতো রেনু তাকিয়েই ছিল ঘোরলাগা চোখে। মাটিতে পড়ে যায় রেনু। দুটি হাত
চারটি হাত লাঠি হাতে ক্রমাগত পিটিয়ে পিটিয়ে শেষ করে দিলো। শুধু রেনুর
জীবনটা নয়, তার সব স্বপ্ন, তার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ।
আমার বোন
রেনুর হত্যার ভিডিওটি যারা করেছেন, যারা দেখেছেন, তাদের সবাইকে অশেষ
ধন্যবাদ। আপনারা সবাই অনেক গোছানো মানুষ। পরিপাটি ফিটফাট, নিরাপদ। রেনু,
বোনটা আমার যদি এর ছিটেফোঁটাও স্মার্ট হতো!
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়