Tuesday, June 18

মিডিয়ার গুরুত্ব আমাদের দায়িত্ব

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী::
ইসলামের প্রচার ও তালিমের জন্য নবী করিম
(সা.) শুরু থেকে শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, দূর-দূরান্তে প্রেরণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম প্রচার হয়েছে দ্বীনের বার্তাবাহী সাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী যুগের ওলি, দরবেশ, আলেম ও বণিকদের মাধ্যমে। তারা তখনকার যুগে মিডিয়ার
দায়িত্ব পালন করেছেন
বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনীতিকে যদি শরীরের রক্ত প্রবাহের সঙ্গে তুলনা করা হয়, মিডিয়াকে তুলনা করতে হবে বায়ু প্রবাহের সঙ্গে। বলা হয়, ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী। নিঃসন্দেহে তা মিডিয়ার কল্যাণে। পৃথিবীর কোন প্রান্তে কী ঘটছে, কোথায় কোন খেলা হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ছবিসহ তা আমাদের সামনে হাজির করে দিচ্ছে। শুধু বর্তমান কেন, অতীতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন সবই ইলেকট্রনিক মিডিয়া কব্জায় নিয়ে তারপর প্রিন্ট মিডিয়া বা ছাপাখানাকে সরবরাহ দিচ্ছে।
মানুষের কথাবর্তা, আচরণ, কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় তার মস্তিষ্ক দিয়ে। মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে সংগৃহীত তথ্য, জ্ঞান, চিন্তা ও বিশ^াস। এই সংগ্রহ নির্ভর করে সংবাদ প্রবাহের ওপর। তার মানে সংগৃহীত সংবাদ আমরা মস্তিষ্কে নিয়ে বিশ্লেষণ করি। সে বিশ্লেষণের ফলাফল নিয়ে আমাদের চিন্তা গঠিত হয়। সেই চিন্তা প্রতিফলিত হয় ব্যক্তির কথায় ও আচরণে। কাজেই ব্যক্তির জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিডিয়া বা সংবাদ সরবরাহ ব্যবস্থার গুরুত্ব যুুক্তি দিয়ে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।
আমেরিকা যখন ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার মিথ্যা অজুহাতে ইরাকের ওপর আগ্রাসন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তখন মিডিয়ার ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছিল, যুদ্ধে ব্যবহৃত গোলাবারুদের সমমূল্যের অর্থ মিডিয়ার পেছনে বিনিয়োগ করেছিল আমেরিকা। ইরাক আগ্রাসনের পক্ষে বিশ্বজনমতের সমর্থন ধরে রাখার জন্য মিডিয়ার ওপর এই নির্ভরতা ও অর্থ বিনিয়োগ তার বিফলে যায়নি।
বিষাক্ত কিংবা দূষিত বায়ু প্রবাহ যেমন জীবনহানির কারণ হয়, আবার প্রভাত সমীরণ বা নির্মল বায়ু প্রবাহের ছোঁয়ায় ফুল ফোটে, ফসল ফলে, জীবন বাঁচে, তেমনি মিথ্যা বানোয়াট কিংবা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ বিশ^সভ্যতার জন্য ধ্বংস বয়ে আনতে পারে, আবার  জীবন জাগার গানে চারদিক মুখরিতও করতে পারে। এ কারণেই ইসলাম সাংবাদিকতা বা সংবাদ সরবরাহের স্পর্শকাতরতার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। বলা হয়েছে, ‘কেউ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনবে যাচাই না করে তা বলে বেড়াবে।’ অর্থাৎ শুনেই তার সত্যাসত্য যাচাই না করে অন্যের কাছে বলে বেড়ানো মিথ্যাচর হিসেবে গণ্য হবে। এ মর্মে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে কোরআন মজিদে। এরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদাররা! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের কাছে কোনো বার্তা নিয়ে আসে, তোমরা তা পরীক্ষা করবে, পাছে অজ্ঞতাবশত তোমরা কোনো সম্প্রদায়কে ক্ষতিগ্রস্ত করে বস এবং পরে তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদেরকে অনুতপ্ত হতে হবে।’ (সূরা হুজরাত : ৬)।
ইসলামের প্রচার ও তালিমের জন্য নবী করিম (সা.) শুরু থেকে শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, দূর-দূরান্তে প্রেরণ করেছিলেন। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম প্রচার হয়েছে দ্বীনের বার্তাবাহী সাহাবায়ে কেরাম বা পরবর্তী যুগের ওলি, দরবেশ, আলেম ও বণিকদের মাধ্যমে। তারা তখনকার যুগে মিডিয়ার দায়িত্ব পালন করেছেন।
আজকের দিনেও ইসলামের দাওয়াত দানে সনাতন ধরনের ওয়াজ মাহফিল, মিলাদ মাহফিল ও তাবলিগের ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। এগুলোর ভূমিকা যথাস্থানে ঠিক। কিন্তু যখন প্রত্যেক মহল মনে করে যে, আমি যে মাহফিল করি বা তাবলিগের দাওয়াত দিই এটিই ইসলামের জন্য যথেষ্ট, কিংবা এর বাইরে ইসলামি তৎপরতার প্রয়োজন নেই, তখনই বিপত্তি ঘটে। তাবলিগ জামাতের বর্তমান সংকটটিও তৈরি হয়েছে এমনই অনুর্বর চিন্তা থেকে। যুগের চাহিদা সামনে রেখে ইসলামের প্রচার, প্রসার ও বিরুদ্ধবাদীদের জবাব দানে মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে।
ফেইসবুক বা পত্রপত্রিকা বা অন্য কোনো মিডিয়ায় যারা ইসলামের পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে চান, তাদের কাছে অনুরোধ, কাদা ছোড়াছুড়ি বা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অন্যের দোষ বের করার পরিবর্তে ইসলামের সৌন্দর্যই সমাজের সামনে তুলে ধরুন।
গোলাপ গাছের গোড়ায় গিয়ে দেখুন, কতক কাঁটার দঙ্গল। যদি কাঁটার কুফল বর্ণনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন, গোলাপের মন মাতানো সুবাস থেকে বঞ্চিত হবেন। কাজেই দোষত্রুটি খোঁজার চেয়ে ইসলামী বিধি-বিধানের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য তুলে ধরাই আমাদের ব্রত হওয়া চাই। মাদ্রাসা বা ইসলামী অঙ্গনের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় উপহারটি হলো, মাদ্রাসা অঙ্গনে মাতৃভাষা বাংলার ব্যাপক চর্চা। পাকিস্তান থাকলে মাদ্রাসা ও আলেম সমাজ উর্দুর পরিম-লে আবদ্ধ থাকতেন। স্বদেশবাসীকে স্বজাতির ভাষায় দ্বীনের দিকে আকৃষ্ট করার সুযোগ অধরা থেকে যেত। স্বাধীনতার কল্যাণে এত বড় নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে কি শেষ করা যাবে?
কোরআন মজিদে বর্ণিত, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকে তার স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি।’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)। বলা যায়, প্রিয় বাংলাদেশে যদি কোনো নবী-রাসুল আসতেন তাহলে অবশ্যই তার কাছে অবতীর্ণ কিতাবটি হতো বাংলায়। অবশ্য পবিত্র কোরআন মজিদ এমন ভাষায় আরবিতে নাজিল হয়েছে, যে ভাষা যেখানেই গেছে স্থানীয় ভাষাকে বিকশিত করেছে। যেমন আরবির প্রভাবে অগ্নিউপাসকদের পাহলভী ভাষা দ্বিতীয় ইসলামি ভাষা ফারসিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সৈন্য শিবিরের উর্দু ভাষাও আজ অন্যতম সমৃদ্ধ ইসলামি ভাষা। এই চেতনাকে ধারণ করে বাংলাভাষাকে বিশ^সভায় সমাসীন রাখতে ইসলামি চেতনায় সমৃদ্ধ করতে হবে। তাহলেই বৃহত্তর গণমানুষের চিন্তা, চেতনা ও  জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটবে। এ লক্ষ অর্জন করতে হলে উজ্জীবিত কলমী সৈনিকদের এগিয়ে আসতে হবে। শুধু রেওয়ায়াত বা ফজিলত জাতীয় বর্ণনাধর্মী রচনা বা অনুবাদ নয়; বরং ইসলামি ভাবধারায় সহিত্য সৃষ্টিতে এগিয়ে আসতে হবে। কাব্য ও গদ্য সাহিত্যে আরবি-ফারসি-উর্দুর মিশেল দিতে তরুণ মাদ্রাসা ছাত্রছাত্রীদের সৃষ্টিশীল প্রতিভার স্ফুরণ ঘটাতে হবে। সাদি, রুমি, হাফিজ, নজরুল, ফররুখ হতে পারে এ ক্ষেত্রে আমাদের দিশারি।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়