Wednesday, July 1

সঙ্গীতের সুরে ঘুম ভাঙে তুরস্কের মুসলিমদের


মোঃ আবুসালেহ সেকেন্দার: এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশের দেশ তুরস্ক দেশ। এদেশের প্রায় ৯৯.৮ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ফলে পৃথিবীর অন্য মুসলিমপ্রধান দেশের মতো তুরস্কেও মাহে রমজান উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। সূর্য উদয় থেকে সূর্যাস্ত। সাহরি থেকে ইফতার- সব সময়ই তুরস্কবাসী রমজানের স্বাদ উপভোগ করে। অন্য মুসলিম দেশের মতোই তুরস্কের মুসলমানরা সূর্য উদয়ের আগে সাহরি খায় এবং সূর্যাস্তের পর ইফতার করে। মসজিদে গিয়ে তারাবি নামাজ পড়ার ক্ষেত্রেও অন্য মুসলিমদের সঙ্গে তুরস্কের মুসলিমদের কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু তুরস্কে মাহে রমজানের নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য রয়েছে, যা অন্য মুসলিম দেশের থেকে স্বতন্ত্র। তুরস্কের মুসলমানদের মাহে রমজানে সাহরির সময় সঙ্গীতের সুরে ঘুম ভাঙে। মাহে রমজানে সাহরির সময় হলে অন্য মুসলিমদের ঘুম ভাঙিয়ে দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত মুসলিমরা বড় বড় ড্রাম বাজাতে বাজাতে পাড়া-মহল্লায় ঘুরতে থাকে। তারা মুসলিমদের ঘুম থেকে তুলে দেয়ার জন্য ড্রামের তালে তালে একটি সঙ্গীতও পরিবেশন করে। সঙ্গীতের সুরে সুরে বাদক দল বলতে থাকে 'ইউয়ানসানা ইউয়ানাসানা' অর্থাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠো। ড্রাম বাজানো ও সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে তারা সাহরি খাওয়ার জন্য মুসলিমদের জাগিয়ে দেয়। তুরস্কের মুসলিমরা সঙ্গীতের সুর শুনতে শুনতে সাহরি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে ওঠে। ভোর রাতে ড্রাম আর সঙ্গীতের সুর সে এক অন্য রকম বেহেশতি পরিবেশের সৃষ্টি করে। সাহরির সময়ে সাধারণত নারীরা প্রথমে ঘুম থেকে জেগে ওঠে এবং তারা সাহরি প্রস্তুত করে। খাবার রান্না করার পর তারাই পরিবারের অন্য সদস্যদের জাগিয়ে দেয়। সাহরির খাবার হিসেবে তারা আদর্শ খাবারই গ্রহণ করে। প্রধানত ভালোমানের রুটি এবং তুর্কি চায়ের মাধ্যমে সাহরি সম্পন্ন করে। অধিকাংশ রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সাহরি সম্পর্কিত অনুষ্ঠান প্রচার করে। অনেক চ্যানেলই ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত ইসলামী সিনেমা দেখায়। ইস্তান্বুল ছাড়াও বড় বড় শহরগুলোতে বাসা ছাড়াও রেস্টুরেন্টে সাহরি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সেখানে মুসলিমদের পাশাপাশি অমুসলিমরা সাহরি খাওয়ার জন্য আসে। রেস্টেুরেন্টের কর্মীরা মুসলিমদের মতো অমুসলিমদেরও সাদরে গ্রহণ করে এবং তাদেরও সাহরি খাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়। রমজানের দিন অফিস-আদালতের সময়সূচির কোনো পরিবর্তন হয় না। তারা অন্য সময়ের মতোই কাজে নিযুক্ত হয়। তবে রমজানের দিনগুলোয় প্রায় সবাই ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করে এবং সাধারণত ইফতারের আগেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করে। মিসরের মতো তুরস্কে ঠিক ইফতারের সময় কামানের গোলা ছোড়া হয়। কামানের গোলার আওয়াজ পেয়ে রোজাদাররা ইফতার শুরু করে। ইস্তান্বুলের মতো বড় বড় শহরগুলোয় হাজারখানেক মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য আজান দেয়া হয়। রমজানে দিনের বেলা রেস্তোরাঁগুলো ঘুমিয়ে যায়। কিছু পাঁচ তারকা হোটেল, খ্যাতনামা রেস্তোরাঁ ও ফাস্টফুডের দোকানগুলো সাহরি ও ইফতারের জন্য বিশেষ ধরনের খাবার তৈরি করে এবং ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বিভিন্ন ধরনের অফার ঘোষণা করে। বড় বড় মসজিদের চারপাশে শত শত দোকানদার নানা স্বাদের ও রকরমের ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে। ওইসব দোকান থেকে রোজাদার মুসলিমরা প্রধানত কর্টন ক্যান্ডি (মিছরি জাতীয় মিষ্টি), মিষ্টি ভুট্টা, রোস্ট চেসনাট, পেস্টারি বা লেই দিয়ে প্রস্তুত জিনিসপত্র, ভেষজ চা প্রভৃতি ক্রয় করে। বেকারিগুলোতে স্থান প্রায় বিখ্যাত 'রমজান পাইড রুটি'। ইফতারের আগে ওই রুটি ক্রয়ের জন্য বেকারির সামনে তুর্কিদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়। সাহরির মতো ইফতারেও অমুসলিমদের তুরস্কের মুসলিমরা সাদরে গ্রহণ করে। তারা অমুসলিম বন্ধুবান্ধবকে ইফতারে দাওয়াত করে। সাধারণ তুর্কিরা বাড়িতে জলপাইয়ের মাধ্যমে ইফতার শুরু করে। ধনী তুর্কিদের ইফতারে গোশত ও নানাপদের শাকসবজির তৈরি ইফতারসামগ্রী স্থান পায়। তারা প্রধানত মিষ্টি খাওয়ার মাধ্যমে ইফতার খাওয়া শেষ করে। অনেক ক্ষেত্রে গুলাক অথবা তুর্কি চা পানের মাধ্যমে ইফতার পর্ব শেষ হয়। সুলতান আহমদ মসজিদের মতো বড় বড় মসজিদ চত্বরে বইমেলারও আয়োজন করা হয় মাহে রমজানে। বইমেলায় তুরস্কের প্রায় সব প্রথম সারির ধর্মীয় প্রকাশনা সংস্থা অংশগ্রহণ করে। বই ক্রয়ে পাঠকদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের ছাড়ের অফারও ঘোষণা করে প্রকাশকরা। ওসমানি সালতানাত ও খিলাফতের যুগে তুরস্কের সুলতান ও খলিফারা রমজানের সময় রাজকীয় প্রাসাদের অভ্যন্তরে ইফতার পার্টির আয়োজন করতেন। ওই ইফতার পার্টিতে ধনী-গরিব, আমির-ওমরাসহ জনসাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল অবারিত। সে ঐতিহ্যকে ধারণ করে বর্তমানে শহরের উন্মুক্ত চত্বরগুলোয় বিভিন্ন সংগঠন ইফতার পার্টির আয়োজন করে। সবার অংশগ্রহণে সেই ইফতার পার্টি এক পারিবারিক মিলনের স্থানে পরিণত হয়। মানব হিতৈষী ও দাতব্য সংস্থাগুলোও রোজাদার মুসলিমদের জন্য নিজেদের খরচে ইফতার পার্টির আয়োজন করে। রমজানের দিনগুলোতে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আল কোরআন পড়া হয়। আয়োজন করা হয় কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার। তারাবির নামাজের সময় মসজিদগুলোতে প্রচুর মুসলি্লর সমাগম ঘটে। ছোট ছেলেমেয়েরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে তারাবি নামাজ পড়তে মসজিদে যায়। ২৭ রমজানে লায়লাতুল কদরের রাতে মুসলি্লরা সারা রাত মসজিদে অবস্থান করে ইবাদত করে। মাহে রমজানে তুরস্কের রাস্তার পাশের গাছ ও ভবনে রমজান-সম্পর্কিত নানা ধরনের ফেস্টুন চোখে পড়ে। মোটকথা, মাহে রমজানে মুসলিম অধ্যুষিত তুরস্ক অন্যরকম এক উৎসবে মুখরিত হয়ে ওঠে।

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়