Friday, December 12

ফেরেশতা আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি


মাওলানা মুহাম্মাদ সিরাজুম মুনীর: ফেরেশতা আল্লাহ তায়ালার সৃষ্ট এক বিশেষ মাখলুক। আল্লাহ তায়ালা তাদের নূর তথা আলো দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, 'ফেরেশতাদের নূর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, জিনদের সৃষ্টি করা হয়েছে ধূম্র মিশ্রিত অগ্নিশিখা দ্বারা, আর আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে তা দ্বারা যার বর্ণনা তোমাদের সমক্ষে তুলে ধরা হয়েছে।' তারা সম্মানজনক যে কোনো আকৃতি ধারণ করতে পারেন। তাদের বিশেষ শক্তি দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন মাখলুকের মধ্যে ফেরেশতাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাদের সঠিক সংখ্যা একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। সূরা মুদ্দাচ্ছিরের ৩১নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি ফেরেশতাদের দোজখের কর্মচারী বানিয়েছি এবং তাদের সংখ্যাকে কাফেরদের জন্য ফেৎনা বানিয়ে দিয়েছি, যাতে আহলে কিতাবদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে, ঈমানদারদের ঈমান বৃদ্ধি পায়, আহলে কিতাব ও ঈমানদাররা সন্দেহ পোষণ না করে, আর যাদের মনে রোগ আছে তারা এবং কাফেররা যেন বলে, এ অভিনব কথা দ্বারা আল্লাহ কী বোঝাতে চেয়েছেন? এভাবে আল্লাহ যাকে চান পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হেদায়েত দান করেন। তোমার রবের বাহিনী সম্পর্কে তিনি ছাড়া আর কেউ অবহিত নন। বোখারি ও মুসলিম শরিফের এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, বায়তুল মামুরে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা তাওয়াফ করে। যারা একবার তাওয়াফ করে বেরিয়ে যায় কেয়ামত পর্যন্ত তারা আর ফিরে আসবে না। মুসলিম শরিফের এক হাদিসে বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন জাহান্নামকে ৭০ হাজার শিকল দ্বারা বেঁধে নিয়ে আসা হবে। প্রতিটি শিকল টানার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা থাকবে। এসব হাদিস দ্বারা ফেরেশতাদের সংখ্যাধিক্যের ধারণা পাওয়া যায়। তাদের আল্লাহ তায়ালা তাঁর ইবাদতের জন্য এবং বিশেষ বিশেষ কাজের জন্য নির্বাচন করেছেন। তারা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের বাইরে কিছুই করে না। তাদের যখন যা করতে বলা হয় তারা তাই করেন। সূরা তাহরিমের ৬নং আয়াতে বলা হয়েছে, হে লোকজন, যারা ঈমান এনেছো, তোমরা নিজেদের এবং নিজেদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিকে সেই আগুন থেকে রক্ষা করো, মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানি। সেখানে রূঢ় স্বভাব ও কঠোর হৃদয় ফেরেশতারা নিয়োজিত থাকবে, যারা কখনও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে না এবং তাদের যে নির্দেশ দেয়া হয় তাই পালন করে। হজরত জিবরাঈল (আ.) সম্পর্কে সূরা নাজমের ৫নং আয়াতে বলা হয়েছে, 'তাকে মহাশক্তির অধিকারী একজন শিক্ষা দিয়েছে, যে অত্যন্ত জ্ঞানী।' এছাড়াও সূরা আত্তাকবিরের ২০নং আয়াতে বলা হয়েছে, 'যিনি বড়ই শক্তিধর, আরশের মালিকের কাছে উন্নত মর্যাদার অধিকারী।' কতগুলো ফেরেশতাকে দেয়া হয়েছে সুবিশাল আকৃতি। যেমন_ মুসলিম শরিফের হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূল (সা.) হজরত জিবরাঈল (আ.)-কে তার স্বীয় আকৃতিতে দেখেছেন আসমান ও জমিন পরিব্যাপ্ত অবস্থায়। মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় রয়েছে, হজরত জিবরাঈল (আ.) এর ৬০০ ডানা রয়েছে, যার প্রতিটি ডানার প্রশস্ততা আসমানের দিগন্ত রেখার সমান। তার ডানা থেকে ইয়াকুত ও মুক্তার দানা ঝরে পড়ে। আবু দাউদ শরিফে হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (সা.) আল্লাহর আরশ বহনকারী এক ফেরেশতার দৈহিক আকৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, তার কানের লতি থেকে কাঁধের দূরত্ব ৭০০ বছরের রাস্তার দূরত্বের সমান। সব ফেরেশতাকে এক আকৃতিতে তৈরি করা হয়নি। কারও দুই ডানা, কারও তিন ডানা, কারও চার ডানা, আবার কারও ৬০০ ডানা। এ মর্মে সূরা ফাতিরের ১নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আকাশগুলো ও পৃথিবীর নির্মাতা এবং ফেরেশতাদের বাণীবাহক নিয়োগকারী (এমনসব ফেরেশতা) যাদের দুই-দুই, তিন-তিন ও চার-চারটি ডানা আছে। নিজের সৃষ্টির কাঠামোয় তিনি যেমনটি চান বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জিনিসের ওপর শক্তিমান। ফেরেশতাদের মূল অবস্থানস্থল হলো আসমান। সেখান থেকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে তারা জমিনে অবতরণ করে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যেমন_ সূরা নাহলের ২নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তিনি এ রুহকে তাঁর নির্দেশানুসারে ফেরেশতাদের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের মধ্য থেকে যার ওপর চান নাজিল করেন। সূরা জুমারের ৭৫নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, তুমি আরও দেখতে পাবে যে, ফেরেশতারা আরশের চারদিক বৃত্ত বানিয়ে তাদের রবের প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছে। ফেরেশতাদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষ নেই। ফেরেশতারা তাসবিহ-তাহলিল ও আল্লাহর ইবাদতে রত থাকেন। কখনও ক্লান্ত বা বিরক্ত হন না। এরশাদ হয়েছে, পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যে সৃষ্টিই আছে তা আল্লাহরই। আর যে (ফেরেশতারা) তাঁর কাছে আসে তারা না নিজেদের বড় মনে করে তাঁর বন্দেগি থেকে বিমুখ হয় এবং না ক্লান্ত ও বিষণ্ন হয়, দিন-রাত তাঁর প্রশংসা ও মহিমা ঘোষণা করতে থাকে, বিরাম-বিশ্রাম নেয় না। (সূরা আম্বিয়া : ১৯, ২০)। এছাড়াও বিশেষ বিশেষ দায়িত্বে বিশেষ বিশেষ ফেরেশতাকে নিয়োজিত করা হয়েছে। ফেরেশতাদের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাশীল ফেরেশতা হলেন হজরত জিবরাঈল (আ.)। তার মূল দায়িত্ব হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে নবীদের কাছে ওহি নিয়ে আসা। প্রধান চার ফেরেশতার বাকি তিনজন হলেন_ হজরত মিকাঈল (আ.), যিনি বৃষ্টিবর্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত; হজরত ইসরাফিল (আ.), যিনি সিঙ্গায় ফুৎকারের দায়িত্ব পালন করবেন; হজরত আজরাঈল (আ.), যার দায়িত্ব হলো সব প্রাণীর জান কবজ করা। এছাড়া রয়েছেন জান্নাতের দ্বার রক্ষক ফেরেশতা রেদওয়ান, জাহান্নামের দ্বার রক্ষক ফেরেশতা মালেক, আমল লেখক ফেরেশতা কেরামান কাতেবিন, কবরে সওয়ালকারী ফেরেশতা মুনকার নকির। পাহাড় পরিচালনার দায়িত্বে, মানুষের হেফাজতের দায়িত্বে, মাতৃগর্ভে সন্তানের পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে, আরশ বহনের দায়িত্বে, দরুদ ও সালাম নবীজির কাছে পেঁৗছে দেয়ার দায়িত্বে আলাদা আলাদা ফেরেশতা রয়েছেন। একজন মোমিনকে মৌলিক যে বিষয়গুলোর ওপর ঈমান আনতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান আনা। এটি কোরআন ও হাদিস দ্বারা সুপ্রমাণিত। কোরআনের সূরা বাকারার ২৮৫নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, তারা সবাই আল্লাহকে, তাঁর ফেরেশতাদের, তাঁর কিতাবগুলোকে ও তাঁর রাসূলদের বিশ্বাস করে। সূরা নিসার ১৩৬নং আয়াতে এরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদাররা! ঈমান আনো আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, আল্লাহ তাঁর রাসূলের ওপর যে কিতাব নাজিল করেছেন তার প্রতি এবং আগে তিনি যে কিতাব নাজিল করেছেন তার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতারা, তাঁর কিতাবগুলো, তাঁর রাসূলদের ও পরকালের প্রতি কুফরি করল, সে পথভ্রষ্ট হয়ে বহুদূর চলে গেল। এখানে ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান না আনলে তাকে কাফের বলা হয়েছে। হাদিসে জিবরাঈলের মধ্যেও হজরত জিবরাঈল (আ.) যখন রাসূল (সা.) কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন তখন রাসূল (সা.) বলেছিলেন, ঈমান হলো, তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর অবতারিত আসমানি কিতাবের প্রতি, তার প্রেরিত রাসূলদের প্রতি, পরকালের প্রতি এবং তাকদিরের ভালো-মন্দের প্রতি। (বোখারি ও মুসলিম)। লেখক : মোহাদ্দেস, ছারছীনা দারুসসুন্নাত কামিল মাদরাসা

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়