অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম
পৃথিবীর আকাশে মহররমের চাঁদ উদিত হলো। ১৪৩৫ হিজরি সনকে আলবিদা জানিয়ে হিজরি নববর্ষ ১৪৩৬-এর আগমন ঘটল। হিজরি নববর্ষকে জানাই খোশ আমদেদ। চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকার অন্তর্ভুক্ত অনন্য পবিত্রতার সৌরভে সুরভিত হিজরি নববর্ষ চন্দ্র পরিক্রমের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী আপন ঘূর্ণি গতিপথে ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে আবির্ভূত হয় নবচাঁদ বা নও হেলালের উদয়ের মধ্য দিয়ে।
হিজরি সনের প্রথম মাস মহররম। মহররমের দশ তারিখকে বলা হয় আশুরা। আশুরার দিনটি সৃষ্টির আদিকাল থেকে অনেক ঘটনার সাক্ষী হলেও, সেসব ছাপিয়ে এদিন বিশেষভাবে মহিমান্বিত হয়েছে কারবালা প্রান্তরে ইমাম হোসাইন (রা.) এর শাহাদাতের কারণে। কারবালার সেই ট্র্যাজেডির কারণে হিজরি নববর্ষের প্রথম দিন আনন্দের হয় না, যেমনটা হয় পহেলা বৈশাখে কিংবা জানুয়ারি শুরুর মুহূর্তে রাত দুপুরে। হিজরি সনের গোড়াপত্তন হয় প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মক্কা মোকাররমা থেকে মদিনা মনোয়ারায় হিজরতের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য।
মক্কায় ইসলামের দাওয়াত শুরুর পর গুটিকয়েক অতি সৌভাগ্যবান ব্যক্তি ছাড়া কাফের-মোশরেকরা তাঁর আহ্বানে সাড়া তো দিলই না বরং তারা তাঁর প্রচারকার্যে নানাভাবে বাধার সৃষ্টি করতে লাগলো, সংঘবদ্ধভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন চালাতে লাগলো, এমনকি সামাজিক বয়কট পর্যন্ত করল। কিন্তু তিনি তাঁর ওপর অর্পিত আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করা থেকে একটুও পিছু হটলেন না। কাফের-মোশরেক নেতারা তাঁকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে কাবু করতে চাইল। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমার এক হাতে চাঁদ আর এক হাতে সূর্য এনে দিলেও আল্লাহ আমাকে যে দায়িত্ব পালন করতে দিয়েছেন, তা থেকে কোনো অবস্থাতেই বিরত হবো না।
এরই মধ্যে ধীরগতিতে হলেও অনেক সৌভাগ্যবান ইসলামে দাখিল হতে লাগলেন। তবুও কাফের-মোশরেকদের অত্যাচারের নিত্য-নতুন মাত্রা সংযোজিত হতে লাগল। এক পর্যায়ে কাফের-মুশরিকরা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রও করল। রাতের অাঁধারে তাঁর গৃহ ঘেরাও করল। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁর বিছানায় হজরত আলী (রা.) কে শুইয়ে রেখে অতি সন্তর্পণে গৃহ থেকে বের হয়ে গেলেন এবং তাঁর নিত্যসহচর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে সঙ্গে নিয়ে তাঁর মাতুলালয় তদানিন্তন ইয়াসরিবের উদ্দেশে রওনা হলেন। এর আগে তাঁর নির্দেশে মক্কা মোকাররমা থেকে অনেক সাহাবিই ইয়াসরিবে গেছেন। যখন ইয়াসরিবে রটে গেল, তিনি আসছেন_ তখন সেখানকার প্রায় পাঁচ হাজার অধিবাসীর মধ্যে এক অনন্য আনন্দ আমেজ জেগে উঠল। কবিরা তাঁকে সংবর্ধনা জানানোর জন্য কাসিদা রচনা করলেন। প্রায় ১৫ দিন ধরে উত্তর দিকে ২৯৬ মাইল মরু-কঙ্কর পথ উটে চড়ে অতিক্রম করে তিনি ইয়াসরিবের উপকণ্ঠ কুবা নামক স্থানে উপস্থিত হলেন। সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং একটি মসজিদ নির্মাণ করে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধসহ এক বিরাট আনন্দ মিছিল নিয়ে তিনি কুবা থেকে তিন মাইল দূরে ইয়াসরিব নগরীর দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে বনি সালিম মহল্লায় সর্বপ্রথম জুমার সালাত আদায় করলেন।
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। তখন থেকেই হিজরতের প্রথম বছর, দ্বিতীয় বছর এমনিভাবে বছরের হিসাব করা হচ্ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, তদানিন্তন আরব দেশে ১২ মাসে বছর হওয়ার রীতি প্রচলিত থাকলেও নির্ধারিত কোনো সন বা বর্ষপঞ্জির হিসাব ছিল না।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর খেলাফতকালে খেলাফতের বিস্তৃতি ঘটে তদানিন্তন পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি এলাকাজুড়ে। বিভিন্ন প্রদেশের আমির বা গভর্নরদের কাছে চিঠিপত্র লেখার ক্ষেত্রে কিংবা নথি, ফরমান, দলিল-দস্তাবেজ ইত্যাদি পাঠানোর ক্ষেত্রে তারিখ হিসেবে শুধু মাসের নাম লেখা হতো। নির্দিষ্ট কোনো সন না থাকায় মাসের নামটি যে কোন বছরের তা বোঝা যেত না, ফলে দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হতো। একটি প্রদেশের গভর্নর হজরত আবু মুসা আল আশয়ারি (রা.) শুধু শাবান মাস লেখা একটি চিঠির উল্লেখ করে লিখলেন, শুধু মাসের নাম লেখা থাকার কারণে দারুণ জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ওমর (রা.) বিশিষ্ট সাহাবায়ে কেরাম সমন্বয়ে সন উদ্ভাবনের জন্য একটি বলিষ্ঠ কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হলো_ কেউ বললেন, প্রিয় নবী (সা.) এর পৃথিবীতে আবির্ভাবের বছর থেকে গণনা করে নতুন সাল প্রবর্তন করা হোক, কেউ বললেন প্রথম ওহি লাভের বছরের কথা, কেউ বা ওফাতের বছরের কথা বললেন। কিন্তু হজরত আলী (রা.) বললেন, হিজরতের বছরের কথা। তিনি যুক্তিও দেখালেন। সবাই তা গ্রহণ করলেন।
হিজরতের ১৭ বছর পর ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে হিজরি সনের প্রবর্তন হলো। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসে হিজরতের ঘটনা ঘটলেও আরবের প্রচলিত মাসগুলোর ক্রম ঠিক রাখার জন্য প্রথম মাস মহররমের এক তারিখ থেকেই এ নতুন সাল গণনা নির্ধারিত হলো।
বিশ্বে প্রচলিত সবচেয়ে পবিত্র সাল হচ্ছে হিজরি সন এবং পৃথিবীর প্রায় ২২৫ কোটি মুসলিমের কাছে এ সন অতি প্রিয়। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের বাংলা সনটিও ৯৬৩ হিজরিকে প্রথম বছর ধরে সৌরগণনায় এনে মোগল সম্রাট জালালুদ্দীন মুহম্মদ আকবরের আমলে প্রবর্তিত হয়। হিজরি সনের প্রতিটি মাস গণনা শুরু হয় চন্দ্র উদয়ের সময় থেকে। চাঁদ দেখার মধ্যেও একটা আনন্দ সৌকর্য রয়েছে, বিশেষ করে ঈদের চাঁদ দেখায়। চাঁদ দেখার মধ্যেই এ সনের গুরুত্ব রয়েছে। এর মাস ২৯ কিংবা ৩০ দিনে হয়।
লেখক : সাবেক পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন
Thursday, October 30
এ সম্পর্কিত আরও খবর
হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ ফেতনা-ফ্যাসাদ: কোরআন ইসলাম শান্তির ধর্ম। মানবতার ধর্ম। আর তাই ফেতনা-ফ্যাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইসলাম কখনোই সমর্থন
অহংকার আর অহংকারীর ভয়ানক পরিণতি সম্পর্কে ইসলাম যা বলছে আমাদের সমাজে একটি কথা বহুল প্রচলিত, তা হলো- ‘অহংকার পতনের মূল’। প্রতিটি মানুষের মধ্যে দুটি শক
২০২৫ এর রোজা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ অলংকরণ: ডেইলি বাংলাদেশমুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে পবিত্র মাস মাহে রমজানের দিনক্ষণ গণনা শুরু হয়ে
জুমার নামাজ না পড়লে যেসব শাস্তি পেতে হবে একজন মুসলমান হওয়ার প্রধান শর্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা। আর একজন মুসলমান ও কাফেরের মধ্যে পা
আজ পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) আজ (১২ রবিউল আউয়াল) পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই দিনে মানব জাতির জ
জুমার আদব রক্ষাকারীর যে ১০ দিনের গুনাহ মাফ হয় জুমার দিন; তথা শুক্রবারের দিন জোহরের নামাজের পরিবর্তে জুমার নামাজকে ফরজ করা হয়েছে। যা আমাদের
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়