নারায়ণগঞ্জ: অব্যাহত প্রবল বর্ষণে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্পের অভ্যন্তরে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। মধ্য ডিএনডিসহ বিভিন্ন স্থানে এক থেকে চার ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে কয়েক লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। ডিএনডির বহু বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিল্প-কারখানা, মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুল-কলেজ, সবজি ক্ষেত ও নার্সারিসহ বিভিন্ন স্থাপনা পানিতে তলিয়ে আছে। ডিএনডি থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের অভাবে ডিএনডিতে এ ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জলাবদ্ধতার শিকার লোকজন অভিযোগ করেন।
শিমরাইলস্থ পাম্প হাউজের ১২৮ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি পাম্প ছাড়াও অতিরিক্ত আরও ৫ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন ২৬টি পাম্প চালু রয়েছে বলে পাম্প হাউজ সূত্র জানায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ডিএনডি প্রজেক্টটি ১৯৬২-১৯৬৮ সালে রাজধানী ঢাকার ডেমরা, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী ও নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানার আট হাজার ৩৪০ হেক্টর এলাকাজুড়ে নির্মিত হয়েছে। ডিএনডি প্রতিষ্ঠার পর এর অভ্যন্তরে শুধু ইরিগ্রেশন প্রজেক্ট ছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ডিএনডি ছিল বন্যামুক্ত। ফরে এর চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। শুরু হয় ডিএনডিতে বসবাসের প্রতিযোগিতা। বর্তমানে প্রজেক্টি ইরিগ্রেশন হিসেবে ধরা হচ্ছে না। এটি একটি আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ডিএনডিতে আনুমানিক ২০ লাখ লোক বসবাস করছে। প্রতিষ্ঠার পরডিএনডিতে সেচ খাল তৈরি করা হয় ৫৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার, নিষ্কাশন খাল ৪৫ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। বর্তমানে এই সেচ খাল ও নিষ্কাশন খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। ফলে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, পাম্প হাউজ নির্মাণের সময় ১৪ দশমিক ৫২ কিউমেক (৫১২ কিউসেক) ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি পাম্প সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল এলাকায় বসানো হয়েছে। অথচ এ পাম্পগুলো ৫০ বছরের পুরোনে। তাই পানি নিষ্কাশনের ক্ষমতা আগের মতো নেই বলেও খোদ কর্মকতাই অকপটে স্বীকার করেন।
এদিকে কয়েক দিনের অব্যাহত প্রবল বর্ষণের পানিতে ডিএনডির প্রজেক্ট অভ্যন্তরে ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সাধারণত নিম্নাঞ্চলের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, স্কুল-কলেজ, মসজিদ- মাদ্রাসা পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে শিশু, মহিলা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ রোজাদারা চরম দুর্ভোগ পোহাতে বাধ্য হচ্ছে। অব্যাহত প্রবল বর্ষণে মিজমিজির পাইনাদী, সিআইখোলা, কালাহাতিয়ার পাড়, নতুন মহল্লা, মজিববাগ, রসুলবাগ, নয়াআটি, নিমাইকাশারী, সানারপাড়, টেংরা, কোদাল দোয়া, তুষার ধারা, বক্সনগর, হাজীগঞ্জ, গিরিধারা, সাহেবপাড়া, বাঘমারা, সাদ্দাম মার্কেট, জালকুড়ি, হাজীনগর, মাতুইয়াল, শহীদ নগর, সবুজবাগ, ভূইঘর, দেলপাড়া, পূর্ব ইজদাইর, ডগাইর, মাতুয়াইল, নয়াপাড়া ও ধনকুন্ডাসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক বাড়িরঘর ও রাস্তাঘাট, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ, সবজি খেত, নার্সারি বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে। স্থান ভেদে ডিএনডির অভ্যন্তর এক থেকে চার ফুট পানিতে ডুবে আছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন। এতে ডিএনডির অভ্যন্তরে বসবাসরত প্রায় কয়েক লাখ লোক পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
ফতুল্লার পূর্ব ইসদাইর এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন জানান, তাদের ঘরে ভেতরে এখন হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট পানির নিচে। তারা নর্দমার কালো কুচ কুচে পানি দিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
একই এলাকার বাসিন্দা ওয়াজউদ্দিন জানান, পূর্ব ইজদাইরের কমপক্ষে দেড়শ বাড়িঘরে পানি ঢুকেছে। লোকজন পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পাইনাদী নতুন মহল্লার প্রধান নিষ্কাশন খালের উত্তর পাড়ের রাস্তাটি ডুবে গেছে। অনেক স্থানে বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাচল করছে লোকজন। অনেক এলাকায় লোকজন বালির বস্তা ও ইট ফেলে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে।
পূর্ব জালকুড়ির খিলপাড়ার বাসিন্দা সোহেল জানান, বর্তমানে আমাদের ওঠানে হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে আছে। দরজায় বাঁধ দিয়ে পানি ঠেকানো হয়েছে। তিনি ডিএনডি থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশন করার দাবি জানান।
ফতুল্লার দেলপাড়ার বাসিন্দা জোৎস্না জানান, বর্ষণের পানিতে তাদের গ্যাসের চুলো ডুবে গেছে। ঘরে রান্না-বান্না বন্ধ হয়ে গেছে। দোকান থেকে খাবার কিনে আনতে হচ্ছে।
ডিএনডি সূত্রে জানা যায়, ডিএনডি থেকে সুষ্ঠুভাবে সেচকার্য পরিচালনা করা এবং পানি নিষ্কাশন করার জন্য ৯টি সেচ খাল, ৯টি ডিটিও খাল, ২১০টি আউট লেক খাল, ৮৫টি চকবন্দী খাল অনুসারে ১০টি নিষ্কাশন খাল রয়েছে। এ ছাড়াও এক কিলোমিটার দীর্ঘ ইনটেক খাল, ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মেইন ক্যানেল টার্ন আউট খাল রয়েছে। এর মধ্যে চ্যানেল-১ খালের দৈর্ঘ ৭ দশমিক ৯০ কিলোমিটার, চ্যানেল-২ এর দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৮০ কিলোমিটার, পাগলা খাল ৩ কিলোমিটার, জালকুড়ি খাল ২ দশমিক ১০ কিলোমিটার, শ্যামপুর খাল ২ দশমিক ৭০ কিলোমিটার, ফতুল্লা খাল ১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার ও সেকেন্ডারি চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার। এ খালগুলোর অধিকাংশই ভরাট হয়ে গেছে বলে ভূক্তভোগীরা জানান।
মিজমিজির বাসিন্দা আহম্মদ উল্লাহ জানান, মিজমিজি টিসি রোড সংলগ্ন কংশ নদী নামে একটি নিষ্কাশন খাল রয়েছে। যে খাল দিয়ে পাইনাদী পূর্বপাড়া, সিআইখোলা, মধ্যপাড়া, মিজমিজি পূর্বপাড়া, মজিববাগ, জুয়েল রোড ও রেকমত আলী উচ্চ বিদ্যালয় এলাকার বৃষ্টির পানি ডিএনডির প্রধান নিষ্কাশন খালে গিয়ে পড়ছে। অথচ এ খালটি ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলেছে। এ ছাড়াও খালটি দখল করে দোকানপাট, অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় পানি দ্রুত নিষ্কাশন হতে পারছে না। এতে ডিএনডির নিচু এলাকার বাসিন্দা এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
ডিএনডির পাম্প হাউজের এক কমকর্তা জানান, নিষ্কাশন খালে পানি পলিথিনসহ বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা এসে পাম্প হাউজের মুখে জমা হচ্ছে। এতে পানি নিষ্কাশনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, পাম্প হাউজের মুখ থেকে প্রতিদিন তিন ট্রাক ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে। তিনি প্রধান নিষ্কাশন খালসহ শাখা-প্রশাখা খালগুলো ময়লা-আবর্জনা না ফেলতে ডিএনডিবাসীকে অনুরোধ জানান।
শনিবার দুপুরে পাম্প হাউজে গেলে কর্মকর্তারা জানান, ১২৮ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি পাম্প ও একই স্থানে পাঁচ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ২২টি পাম্প এবং ডেমরার বামৈল ও শুকুরসীতে আরও ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি সার্বক্ষণিক চালু রয়েছে। তবে তারা বলছেন, যদি আর বৃষ্টিপাত না হয় তবে ডিএনডি থেকে পুরোপুরি পানিষ্কাশন করতে অন্তত ১৫ দিন সময় লাগবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবোর) ঢাকা যান্ত্রিক পাম্প হাউজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এম গোলাম সারওয়ার ডিএনডিতে ব্যাপক জলাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে জানান, ডিএনডি থেকে দ্রুত পানি নিষ্কাশন করতে হলে ৮৮ কিউমেক ক্ষমতা সম্পন্ন আরও নতুন তিনটি পাম্প স্টেশন নির্মাণ করতে হবে। তাহলে ডিএনডিবাসী জলাবদ্ধতার কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে। তিনি জানান, যদি আরও ৩-৪ দিন একটানা বৃষ্টি হয় তবে ডিএনডির ৮০ ভাগ এলাকা ডুবে যাবে। বর্তমানে পাম্প হাউজটি প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। কারণ ১৯৬৮ সালে নির্মাণ করা এ পাম্প হাউজটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে।