বিক্রমপুর জাদুঘরে স্থান পেয়েছে বিক্রমপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন। ঘুরে এসে লিখেছেন- গাজী মুনছুর আজিজ
সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা চারপাশ। তার মাঝে বিশাল পুকুর। শানবাঁধানো ঘাটও আছে। আরও আছে সাম্পান নৌকা। পুকুর পাড়ে অনেকগুলো পুরনো বাড়ি। কিছু বাড়ি পরিত্যক্ত। কিছু বাড়িতে লোকজন আছেন। আর এ পুকুরপাড়েই পুরনো বাড়িগুলোর পাশে গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘর। এছাড়া পুকুরে যে সাম্পান নৌকা ভাসানো- এটি নৌকা জাদুঘরের প্রতীকী। আর এ জাদুঘরগুলো রয়েছে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার উত্তর বালাসুর গ্রামে। ১০ সেপ্টেম্বর এ জাদুঘরগুলো দেখতে গিয়েছি সেখানে।
বিক্রমপুর জাদুঘর
পোড়ামাটির খেলনাসহ অনেক প্রত্নতাত্তিক নির্দশন দেখা যাবে জাদুঘরে
গুলিস্তান থেকে আরাম বাসে আরাম করে রওনা হই সকালে। বুড়িগঙ্গা পার হয়ে বাস যখন কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা অতিক্রম করছে, তখন থেকেই রাস্তার দুই পাশে দেখতে পেলাম কাশফুলের বাগান। যতদূর চোখ যায় শুধুই কাশফুল। সত্যিই দারুণ। ধলেশ্বরী সেতু পার হয়ে বাস চলে এগিয়ে। রাস্তার দুই পাশে তখন শুধুই বিল আর বিল।
ঘণ্টা দেড়েকের মাথায় বাস এসে থামল বালাসুর বাজারে। নেমে হালকা নাশতা সেরে এখানকার সামাদ ভাইয়ের দোকানে গরুর দুধের চা খেলাম পরপর দুই কাপ। দারুণ স্বাদ। তারপর রিকশায় রওনা হই জাদুঘরের দিকে। ১৫ মিনিটের মাথায় এসে নামলাম জাদুঘরের সামনে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন নামের সংগঠন বিক্রমপুর জাদুঘর ও নৌকা জাদুঘর দুটি প্রতিষ্ঠা করেছে। ২০ জুন বিক্রমপুর জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে নৌকা জাদুঘরেরও উদ্বোধন করা হয়।
বিক্রমপুর জাদুঘর
জাদুঘরে স্থান পাওয়া তালপাতায় লেখা পুঁথি
বিক্রমপুরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন সংরক্ষণের লক্ষ্যেই ১৯৯৮ সালের ২৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে অগ্রসর বিক্রমপুর সংগঠনটি। লৌহজংয়ের কনকসারে পাঠাগার স্থাপনের মাধ্যমে শুরু হয় এর যাত্রা। সংগঠনের উদ্যোগে মুন্সীগঞ্জের মালপাড়ায় নির্মাণ করা হয়েছে গবেষণা কেন্দ্র। এছাড়া ক্রমান্বয়ে নেয়া হয়েছে অনেক উদ্যোগ। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- শ্রীনগরের রঘুরামপুর ও নাটেশ্বর গ্রামে প্রত্নতাত্তি্বক খনন করা। এসব খননে প্রচীন বৌদ্ধ বিহার আবিষ্কৃত হয়েছে। পাওয়া গেছে বহু প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন। প্রত্নতাত্তি্বক সেসব নিদর্শন এবং সংগঠনের উদ্যোগে সংগ্রহ করা অন্যান্য নিদর্শন দিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে বিক্রমপুর জাদুঘরটি। আর যেখানে জাদুঘরটি করা হয়েছে এটি জমিদার যদুনাথ রায়ের পরিত্যক্ত বাড়ি। অগ্রসর বিক্রমপুর এ বাড়িটি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে করেছে এ জাদুঘর।
তিনতলা ভবনের এ জাদুঘরে প্রবেশ করলেই দুই পাশে দেখা যাবে দুটি বড় মাটির পাতিল। নিচতলার বাঁ পাশের গ্যালারিটি যদুনাথ রায়ের নামে। এ গ্যালারিতে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, রঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির নল, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্তি্বক বিভিন্ন নিদর্শন রয়েছে।
নিচতলার ডান পাশের গ্যালারিটি স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর নামে। এ গ্যালারিতে আছে ব্যাসাল্ট পাথরের বাটি, গামলা, পাথরের থালা, পোড়ামাটির ইট, টালি, বিক্রমপুরের নানা প্রত্নতাত্তি্বক স্থাপনার ছবিসহ বিভিন্ন নিদর্শন।
বিক্রমপুর জাদুঘর
সিরামিকের থালা স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে
দ্বিতীয় তলার বাঁ পাশের মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে দেখা যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি, ইতিহাস, দলিল, বই ও বিভিন্ন নমুনা। আর ডান পাশের গ্যালারিতে রয়েছে বিক্রমপুরে জন্ম নেয়া মনীষীদের জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত। আরও আছে কাগজ আবিষ্কারের আগে প্রাচীন আমলে যে ভূর্জ গাছের বাকলে লেখা হতো সে ভূর্জ গাছের বাকল, তালপাতায় লেখা পুঁথি, কাঠের সিন্দুক, পাকিস্তান আমলের মুদ্রা, তাঁতের চরকা, পোড়ামাটির মূর্তি, সিরামিকের থালাসহ প্রাচীন আমলে স্থানীয় মানুষের ব্যবহার্য বিভিন্ন নিদর্শন। এছাড়া তৃতীয় তলার গ্যালারি এখনও চালু হয়নি।
বিক্রমপুর জাদুঘরের কর্মাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোঃ শাহজাহান মিয়া বলেন, সামনে জাদুঘরে আরও নিদর্শন বাড়নো হবে। এছাড়া নৌকা জাদুঘরের সাম্পান নৌকাটি আনা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। খুব শিগগিরই নৌকা জাদুঘরে যোগ হবে ভাগ্যকুলের জমিদারের প্রাচীন নৌকা। ধীরে ধীরে এ পুকুরে ভাসানো হবে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নৌকাও। আর এ নৌকা জাদুঘরটি এদেশের প্রথম। এছাড়া অগ্রসর বিক্রমপুরের উদ্যোগে আগামী ২০ সেপ্টেম্বর মুন্সীগঞ্জের মালপাড়ায় চালু হবে জ্ঞানপীঠ স্বদেশ অন্বেষণ গবেষণা কেন্দ্র। আর লৌহজংয়ে এগিয়ে চলছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ জাদুঘরের কাজ।
বিক্রমপুর জাদুঘর
নৌকা জাদুঘরের সাম্পান নৌকা
জাদুঘর দেখে এলাম পুকুরের ঘাটে। পুকুর, গাছগাছালি, জমিদার বাড়ি- সব মিলিয়ে ছিমছাম ছায়াশীতল বালাসুর গ্রামখানি সত্যিই মায়াময়। কিছুটা সময় পুকুরঘাটে বসে তারপর এলাম উত্তর বালাসুর বাজারে। সেখান থেকে রিকশায় এলাম বালাসুর বাসস্ট্যান্ড বাজারে। দুপুরের খাবার খেলাম একটি হোটেলে। তারপর সামাদ ভাইয়ের এক কাপ চা খেয়ে আবার উঠলাম আরামে ঢাকার উদ্দেশে।
প্রয়োজনীয় তথ্য : ঢাকার গুলিস্তান থেকে বালাসুরের উদ্দেশে আরাম বাস ছাড়ে কিছুক্ষণ পরপর। ভাড়া ৬৫ টাকা। সময় লাগবে প্রায় দেড় ঘণ্টা। বালাসুর নেমে রিকশায় যাওয়া যাবে জাদুঘরে। ভাড়া ২০ টাকা। খাওয়ার জন্য বালাসুর বা উত্তর বালাসুরে আছে কয়েকটি রেস্তোরাঁ। জাদুঘর খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে ১টা পর্যন্ত ও ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬ পর্যন্ত। সাপ্তাহিক বন্ধ বৃহস্পতিবার।
ছবি : লেখক
খবর বিভাগঃ
ইতিহাস
দর্শনীয় স্থান
ফিচার
0 comments:
পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়