Sunday, September 1

তিনশ পেশাদার কিলারের নিয়ন্ত্রণে রাজধানী

ঢাকা : ওরা পেশাদার কিলার। তবে সাদা চোখে তাদের অনেকেই গার্মেন্ট শ্রমিক, চায়ের দোকানদার, ফল ব্যবসায়ী, স্কুল-কলেজের ছাত্র কিংবা মহল্লার বখে যাওয়া তরুণ। তাদের অনেকের নামেই থানায় মামলা কিংবা সাধারণ ডায়েরিও নেই। অথচ হরহামেশাই তারা অংশ নিচ্ছে চাঁদাবাজি, ভীতি প্রদর্শনের জন্য গুলি, কিংবা খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তারা আখ্যায়িত হয় 'কামলা' হিসেবে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়াতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা নিজ এলাকা বাদ দিয়ে অন্য এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে। টার্গেট বাস্তবায়নের পর সুবোধ ব্যক্তি হিসেবেই তারা ফিরে আসছে নিজ এলাকায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমনই তিন শতাধিক পেশাদার কিলার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজধানী। কার্যত রাজধানীর অপরাধ জগৎ ওদের নিয়ন্ত্রণে। সুনির্দিষ্ট সংখ্যা দিতে না পারলেও এই বাস্তবতার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। 
সর্বশেষ গতকাল মিরপুরের শাহ আলী রকি, আরামবাগ এলাকার প্রবাসী সাবি্বর আহমেদ, গত বৃহস্পতিবার পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফজলুল করিম, গত মাসে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যাকাণ্ডেও পেশাদার কিলাররা অংশ নিয়েছিল বলে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা। 
র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, রাজধানীতে কতজন পেশাদার খুনি সক্রিয় তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও খুনের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তালিকা হয়। অবশ্য এই তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। কারণ নতুন নতুন মুখ অপরাধ জগতে নাম লেখাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় পেশাদার কিলার রয়েছে। তারা তাদের বসদের স্বার্থ হাসিলের জন্য খুন করে। এসব কিলারের সংখ্যা তিনশরও বেশি হবে। তবে র্যাবের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। অপরাধী যেই হোক তাকে আইনের আওতায় আনতে র্যাব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পলাতক এবং কারাবন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আশ্রয়-প্রশয়ে এসব কিলার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছে। তাদের অনেকেই মাসিকভিত্তিক আবার অনেকে অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজে অংশ নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে কেবলই নেশার টাকা জোগাড় করতে মাত্র ৫-৭ হাজার টাকার জন্যই এসব কিলার জড়াচ্ছে খুনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে। পরবর্তীতে হয়ে উঠছে পেশাদার কিলার। তবে খুনের বিনিময়ে পাওয়া ওই টাকার অঙ্ক কখনো ২০-৩০ হাজারের বেশি নয় বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের হাতে গ্রেফতারকৃতরা। কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের মজুরির মোটা অংশই চলে যায় গ্রুপ লিডার এবং মধ্যস্থতাকারীর পকেটে।
সূত্রে জানা গেছে, পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী মুকুলের সেকেন্ড ইন কমান্ড রুবেলের আশ্রয়ে রাজধানীর মহাখালী, তেজগাঁও, কুড়িল বস্তি, বনানী এলাকায় অবস্থান করছে অন্তত ২০ জন কিলার। তাদের অন্যতম মিলন, নুরু, সবুজ, মোতালেব, ব্যাংকক সুমন, রমজান। গত রোজার ঈদের রাতেও ভাঙ্গারি রফিককে গুলি করে হত্যা করে ব্যাংকক সুমনের গ্রুপ। তারা ভাড়ায় শান্তিনগর, কাকরাইল, রামপুরাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কাজ করে। ভাঙ্গারি রফিক হত্যা মামলায় গ্রেফতারকৃত শিমুল আজাদ ওরফে শিমুলের কাছ থেকে এই এলাকার কিলারদের সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় র‌্যাব।
গত বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের আমলে দুটি একে-৪৭ নিয়ে গ্রেফতার হওয়ার পর আলোচনায় আসে রুবেল। পরবর্তীতে জামিনে বের হয়ে একের পর এক অপরাধে জড়াতে থাকে। সর্বশেষ ২০১১ সালে মহাখালী ফুলঝুড়ি হোটেলে যুবলীগ নেতা লিটন পাশাকে প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যার পর আবারও আলোচনায় চলে আসে রুবেল। গ্রেফতারের মাত্র আট মাসের মাথায় জামিনে বের হয় সে। বর্তমানে মহাখালী যক্ষ্মা হাসপাতালসহ মহাখালী এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে। সপ্তাহের অন্তত দুই দিন তাকে যক্ষ্মা হাসপাতাল এলাকায় দেখা যায়। পলাতক যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাড্ডার মাহাবুব, রবিন, ডালিমকেও মহাখালী এলাকায় নিয়মিত দেখা যায়। তবে মিল্কি হত্যাকাণ্ডের পর কিলার কন্নির সোহেল, সোহাগকে দেখা যাচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছে সূত্র।
এদিকে পলাতক এবং কারাবন্দী পাঁচ শীর্ষ সন্ত্রাসীর এলাকা মগবাজার এখনো অন্তত ২০ জন চিহ্নিত সন্ত্রাসীর আস্তানা। তাদের অন্যতম রনি, রিপন, দুই সহোদর মাহবুবুর রহমান রানা ও মিঠু, মধুবাগের মিঠু, নয়াটোলার সানাউল্লাহ, ঝিলপাড়ের বাপ্পি ও তারেক। এসব কিলারকে ব্যবহার করা হচ্ছে চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে। পলাতক সন্ত্রাসী সিয়াম এবং জাকিরের হয়ে কাজ করছে তাদের একটি অংশ। মগবাজার টিএন্ডটি কলোনি এলাকা থেকে উঠানো চাঁদার একটি অংশ পৌঁছে যাচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনসহ আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পকেটে।
র‌্যাব-৩ এর উপ-অধিনায়ক মেজর এমারত বলেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কঠোর মনিটরিং চলছে। অপরাধীরা যেই হোক না কেন তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। কোনো ছাড় নেই। 
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মশিউর রহমান জানান, মিরপুর, বাড্ডা, মহাখালীর কড়াইল বস্তি, পুরান ঢাকার অনেক সন্ত্রাসী পেশাদার কিলিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাদের অনেকেই আবার নিম্নশ্রেণীর পেশায় জড়িত। অপরাধ করার পরই তারা স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। অনেক সময় এসব অপরাধীর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করাও সম্ভব হয়ে উঠে না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পুরান ঢাকার নাক বোঁচা বাবুল, নীলফামারীর জিপি টাওয়ারের কর্মচারী সহিদ, ঠুণ্ডা সাগর ও তার বড় ভাই রমজান, মিরপুর-২ এর সজীব, নারায়ণগঞ্জ সোনারগাঁয়ের হারুন রাজধানীর গুলশান-বনানী এলাকায় কন্ট্রাক্ট কিলিংয়ের কাজ করে। তাদের অনেকেই ক্রসফায়ারে নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী ডাকাত শহিদের পক্ষে কাজ করত।
২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর মিরপুরের অন্ধ কল্যাণ সমিতির মহাসচিব হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয় মহাখালী কড়াইল বস্তির রমজান। সে মাত্র পাঁচ লাখ টাকায় কন্ট্রাক্ট কিলিংটি সম্পন্ন করে। ওই সময় তার সঙ্গে অংশ নিয়েছিল পলাতক ঠুণ্ডা সাগর, সোহাগ, দয়াগঞ্জের সুইপার পট্টির সহিদ। অংশগ্রহণকারীরা পেয়েছেন ১৫ থেকে ২৫ হাজার টাকা। 
পরবর্তীতে গত বছর মিরপুরের জিয়া হায়দার হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া বখাটে জিতু, বগা সজীব ওরফে শরীয়তপুরের মামুন ওরফে হেরোইঞ্চি মামুন গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, তাদের এ কাজে নিয়োজিত করেছিল পলাতক যুবদল নেতা মিলন, যুবলীগ নেতা আয়নাল। তারা বিভিন্ন সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিলিংয়ের কন্ট্রাক্ট নেয়। 
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল কাফরুলে ছাত্রলীগ নেতা ফজলুল হক বাবু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পেশাদার কিলার আজাদ স্বপন, রুম্মান, সাইমনের কাছ থেকে তিনটি অস্ত্র ও ২২ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। তারা পেশাদার কিলার হিসেবে কাজ করে বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দারা। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যা, অস্ত্র মামলা রয়েছে। 
গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। তারা জানায়, ছাত্রলীগ নেতা গোলাম মাহাদী টিটু, কাজীপাড়া হাটখোলার স্বপন, শেওড়াপাড়ার বর্তমানে সাভারে অবস্থানকারী কিলার কামরুজ্জামান আজাদ, স্বাধীন, কাইল্যা জিতু, যুবলীগ নেতা সৈনিক রুবেল, জিকন, ভাষানটেকের হাতকাটা সুমন, নাগর চেয়ারম্যানের জামাই বিভিন্ন সময় কিলিং এবং চাঁদাবাজির কন্ট্রাক্ট নেয়। 
র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কামরুল হাসান জানান, সম্প্রতি মিরপুরের মাজার রোডে মাহাদী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর চাঁদাবাজরা কিছুটা শান্ত। তবে মাঝে মাঝেই মেজর (অব.) জিয়াউদ্দীন, পিচ্চি বিকাশ, পিচ্চি রফিক, সাগরের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ তারা পাচ্ছেন। অভিযোগ পাওয়ার পরপরই তা গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।-বা: প্র:

শেয়ার করুন

0 comments:

পাঠকের মতামতের জন্য কানাইঘাট নিউজ কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়